Recents in Beach

মাতৃমন্দির : এক সাধারণ মায়ের অসাধারণ হওয়ার গল্প

 

একটি অনুপ্রেরণাদায়ক বাংলা গল্প - মাতৃমন্দির

স্বামী মহেশের মৃত্যুর পর লক্ষীদেবী কীভাবে তার দুই পুত্র রমেশ ও নরেশকে ডাক্তার ও বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তোলেন? পড়ুন "মাতৃমন্দির - Bangla Golpo" - জীবনসংগ্রাম, মাতৃপ্রেম ও শিক্ষার এক অনবদ্য বাংলা বড়গল্প/মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প/আবেগঘন গল্প/শিক্ষামূলক গল্প ।

গল্পটি পড়ুন : এক গ্রামে মহেশ নামে একজন ছুতোর তার পরিবার নিয়ে থাকতো তার পরিবারে তার স্ত্রী আর দুই ছেলে ছিল ছেলেদের একজনের নাম ছিল রমেশ আর অন্যজনের নরেশ গ্রাম থেকে একটু দূরে বাস স্ট্যান্ডের কাছে তার ছিল একটি দোকান সেখানে সে আশেপাশের লোকজনের প্রয়োজনীয় কাঠের জিনিস বানাতো তার ব্যবহার আর হাতের কাজ ছিল খুব সুন্দর তাই দূর দূর গ্রামেও সে ছিল খুব পরিচিত এবং অনেক দূর দূর থেকেও তার কাছে লোক কাজ করাতে আসতো আর সে খুব উচিত মূল্যে কাজ করতো গ্রামের লোকেদের সঙ্গেও তার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল অন্যের প্রয়োজনে, বিপদে-আপদে সে আর তার স্ত্রী সবসময় গ্রামের লোকেদের পাশে থাকতো

আর্থিক অভাব তাদের খুব একটা ছিলো না আর তারা খুবই সাদামাঠা জীবন-যাপন করতো মহেশ ছিল খুবই পরিশ্রমী আর সৎ সে নিজের পরিশ্রমে আর চেষ্টায় নিজের বাড়ি, বাসস্ট্যান্ডে একটি দোকানের সঙ্গে শঙ্গে কিছু চাষের জমিও কিনে ছিলো মহেশের আরো একটি গুণ ছিলো সে কখনো কারো কাছ থেকে ধার করতো না তার দুই ছেলেই গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করতো আর তারা পড়াশোনাতে খুব ভালোও ছিলো তার স্ত্রী লক্ষী মাধ্যমিক অবধি পড়াশোনা করেছিলো সংসারের সব কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের পড়াশোনার ব্যাপারে সে সবসময় খেয়াল রাখতো সন্ধ্যাবেলা সব কাজ সারার পরে সে রোজ ছেলেদের নিয়ে পড়াতে বসাতো

কিন্তু একদিন রাতের বেলায় দোকান থেকে ফেরার সময় মহেশকে বিষধর সাপে কামড়ালো শহরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও তাকে বাঁচানো গেলো না গ্রামের লোকজন, আত্মীয়-স্বজন সবাই এলো, সবাই হায় হায় করতে লাগলো কেউ লক্ষীকে আবার বিয়ে করার পরামর্শ দিলো তো কেউ আবার তাকে বাপের বাড়ি চলে যেতে পরামর্শ দিলো মহেশের পারলৌকিক কাজ হয়ে যাওয়ার পরে তার ভাইয়েরা লক্ষীকে সব বিক্রি করে দিয়ে তাদের বাড়ি গিয়ে থাকতে বললো কিন্তু লক্ষীর আত্মসম্মান বোধ ছিল প্রবল সে কোথাও গেলো না দুই ছেলেকে নিয়ে সে গ্রামেই রয়ে গেলো গ্রামের লোকেরা তাকে যথেষ্ট সাহায্য করতো

একটি অনুপ্রেরণাদায়ক বাংলা গল্প - মাতৃমন্দির

মাতৃপ্রেম ও জীবনসংগ্রাম

কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরে লক্ষী গ্রামের স্কুলে প্রধান শিক্ষক অমিয়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলো আর তাঁকে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিয়ে নিজেদের ছেলেদের পরিচয় দিলো আর বললো, যেহেতু তাদের বাবা আর বেঁচে নেই তাই তিনি যেন অভিভাবকের মতো তার ছেলেদের একটু দেখাশোনা করেন, টাকা-পয়সার ব্যাপারটা লক্ষী দেখবে এর আগে সেই গ্রামে কখনো এইরকম অনুরোধ নিয়ে সেই শিক্ষকের কাছে কেউ আসেনি গ্রামের একজন সাধারণ আটপৌরে মহিলা যে এইরকম একটি অনুরোধ নিয়ে তার কাছে আসতে পারে সে আশা তিনি এর আগে করেননি তিনি লক্ষীকে কথা দিলেন তার ছেলেদের পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি সবকিছু খেয়াল রাখবেন এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন তারপর থেকে তিনি স্কুলের ছুটির পরে তার বাড়িতে রমেশ আর নরেশকে টিউশন পড়াতে লাগলেন

স্কুলের প্রধানশিক্ষক অমিয়বাবু একা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন, নিজেই রান্না-বান্না করে নিতেন, বিয়ে-থা করেননি কলকাতায় বাড়ি আছে, কিন্তু থাকার মতো কেউ নেই কারণ তার বাবা-মা গত হয়েছেন, আর তার কোন ভাই-বোনও নেই থাকার মধ্যে বাবার সময়ের একজন পুরানো বৃদ্ধ চাকর, তা্রও তিনকূলে কেউ নেই, তাই কিছুটা তারই জন্য কলকাতার বাড়িটা বিক্রি করে দেননি কারণ সে বেচারার তাহলে মাথা গোঁজার ঠাই থাকবে না তিনি প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে দেন, তাতেই বুড়ো মানুষটা চালিয়ে নেয় আর তিনি লম্বা ছুটি-ছাটা পেলে বাড়ি যান

হিসাবী জীবন

লক্ষী তার স্বামীর দোকানটা একজনকে ভাড়ায় দিয়ে দিলো আর যা জমি-জমা ছিলো লোক দিয়ে সেগুলো চাষ করাতে লাগলো ছেলেরা স্কুলে চলে গেলে সে নিজে গিয়ে ক্ষেতের কাজ দেখাশোনা করতো এছাড়াও সে নিজের বাড়ি সংলগ্ন যেটুকু জায়াগা ছিলো, তাতে নিজেদের খাওয়ার মতো সবজি ফলিয়ে নিতো আর তার হাতের গুণ ছিলো বলার মতো যা সবজি সে চাষ করতো, তাতেই দারুণ ফসল হতো নিজেদের খাওয়ার মতো সবজি রেখে সে বাজারের সবজিওয়ালাদের বিক্রি করে সেখান থেকেও কিছু আয় করতে পারতো তার ছেলেরা্ও তাদের মায়ের কষ্ট আর পরিশ্রম দেখতো আর প্রচন্ড জেদের সঙ্গে পড়াশোনা করতো রাতে পড়াসোনা করে, খাওয়া-দা্ওয়ার পরে লক্ষীর সঙ্গে তার দুই ছেলে ঠোঙা বানাতো, আর লক্ষী তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো গল্প করতো, স্কুলের খবর, তাদের পড়াশোনার খবর নিতো প্রতি মাসে যা টাকা উপার্জন হতো, সে চার ভাগে ভাগ করতো একটি তার সংসারের জন্য, দ্বিতীয়টি তার  ছেলেদের পড়াশোনার জন্য, তৃতীয়টি ছেলেদের উচ্চশিক্ষার জন্য, চতুর্থটি ভবিষ্যতের জন্য কোন কারণে দরকারে পড়লে  

শিক্ষকের ভূমিকা

লক্ষীর পরিশ্রম, তার ছেলেদের অধ্যবসায় এবং পরিশ্রম আর স্কুলের প্রধানশিক্ষক অমিয়বাবুর সাহায্য ফল দিতে লাগলো লক্ষীর দুই ছেলেই স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করা শুরু করলো স্কুলের প্রতিটি শিক্ষক রমেশ আর নরেশকে সাহায্য করতে লাগলো তারা বুঝতে পারলো তারা দুই ভাই ভবিষ্যতে তাদের স্কুলের নাম উজ্জ্বল করতে পারবে ছেলেদের জন্য লক্ষীর স্কুলে, রাস্তায়-বাজারে সম্মান বেড়ে গেলো

লক্ষী আর তার দুই ছেলের লড়াই চলতে লাগলো দেখতে লক্ষীর বড় ছেলে রমেশ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সারা রাজ্যে সপ্তম স্থান পেয়ে পাশ করলো আর সায়েন্স নিয়ে উচ্চ-মাধ্যমিকে পড়াশোনা করতে লাগলো অমিয়বাবু প্রথমে ভেবেছিলেন যে টাকা-পয়সার জন্য হয়তো রমেশের পড়াশোনায় অসুবিধা হবে, তাই তিনি রমেশের মাকে অর্থ  সাহায্যের কথা বলবেন ভেবে তার বাড়িতে গেলেন কিন্তু রমেশের মা লক্ষী তাকে সেই একই কথা বললেন, আপনি রমেশের জন্য সব ব্যবস্থা করে দিন, টাকা-পয়সার জন্য ভাববেন না আপনার কাছে আমার একটাই চাওয়ার - আপনি সঠিক পথনির্দেশ করে ওদের উচ্চশিক্ষিত করে তুলুন

অমিয়বাবু যখন বাড়িতে ফিরছিলেন, তার মনে তখন অদ্ভূত এক ঝড় বইছিলো সাধারণ একজন গ্রামের মহিলার আত্মসম্মানবোধ, মর্যাদাবোধ, সম্ভ্রম এবং লড়াইয়ের এক অসাধারণ প্রতিমূর্তিকে দেখে তার মনে সেই লক্ষীদেবীর প্রতি অদ্ভূত এক সম্মান জন্মালো গ্রামের এক সাধারণ মায়ের তার সন্তানদের জন্য আত্মত্যাগ, লড়াই লক্ষীকে তার সামনে এক অসাধারণ মহিলা এবং এক অসামান্য মায়ের প্রতিমূর্তি বলে মনে হতে লাগলো অন্য কিছু নয়, লক্ষীকে দেখে কেন জানি না অদ্ভূতভাবে তার নিজের মায়ের কথাই মনে পড়ছিলো মনে পড়ছিলো তাকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য তার বিধবা মায়ের লড়াই  

দেখতে দেখতে সময় কেটে যেতে লাগলো এখন নরেশও মাধ্যমিকে নবম স্থান পাওয়ার পরে সায়েন্স নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পড়ছে আর রমেশ ডাক্তারী পড়ছে কলকাতায়  অমিয়বাবু নরেশের পড়াশোনার সবকিছুর খবর রাখেন যে মাস্টারমশাইয়েরা নরেশকে পড়ান তাদের সঙ্গে কথা বলেন উচ্চমাধ্যমিকে নরেশ দারুণ ফল করলো, সেইসঙ্গে ডাক্তারীর এন্ট্রান্স পরীক্ষাতেও খুবই ভালো রেজাল্ট করলো নরেশ অমিয়বাবুকে প্রণাম করতে এসে জানালো যে, তার মা তার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান তিনি যদি একবার সময় করে তাদের বাড়ি যান তাহলে খুব ভালো হয়

মায়ের আত্মত্যাগ

সন্ধ্যাবেলাতে অমিয়বাবু যখন নরেশদের বাড়ি গেলেন, দেখলেন রমেশও কলকাতা থেকে বাড়ি এসেছে অমিয়বাবুকে দেখে রমেশ তাকে প্রণাম করলো অমিয়বাবু জানতে চাইলেন তার পড়াশোনা কেমন চলছে রমেশ জানায় এখন পর্যন্ত সবকটি পরীক্ষাতেই সে প্রথম হয়েছে্ এবং সে হৃদরোগ নিয়ে পড়াশোনার দিকে এগোচ্ছে এবং বিভাগীয় প্রধান তাকে বিশেষ ভালোবাসেন এবং তিনি কথা দিয়েছেন যে, রমেশকে তিনি বিনা পয়সায় বিদেশে হৃদরোগ নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য সব ব্যবস্থা করে দেবেন সব শুবে অমিয়বাবু খুব খুশি হলেন

লক্ষীদেবী নরেশকে সঙ্গে করে অমিয়বাবুর জলখাবার হাতে ঘরে ঢুকলেন জলখাবারের প্লেট অমিয়বাবুর সামনে রেখে বললেন, স্কুল থেকে ফিরে কিছু খাননি, এখানে চলে এসেছেন এগুলো খেয়ে নিন, আপনার সঙ্গে বিশেষ কথা আছে অমিয়বাবু লক্ষ্য করেছেন, লক্ষীদেবীর কথায় অনুরোধ নয়, যেন মায়ের আদেশ মেশানো থাকে তিনি কথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করেন এবং বলেন, বলুন কি ব্যাপারে কথা আছে লক্ষীদেবী বলেন, দেখুন নরেশ বলছে সে ডাক্তারী পড়তে চায় না, আর সেই  নিয়ে রমেশের সঙ্গে তার মতবিরোধ হচ্ছে কারণ, রমেশের ইচ্ছা যে, তার ভাই তারই মতো ডাক্তারী পড়ুক, যখন তার ভাই তার থেকেও ভালো রেজাল্ট করেছে আমি এইসব কিছু বুঝি না, আপনিই এদের সঙ্গে কথা বলে স্থির করে দিন, কি নিয়ে তার পড়া উচিত আর এইসব আলোচনায় আপনার বেশ রাত হবে, আপনি বাড়ি ফিরে রান্না করে খেতে দেরী হবে, সুতরাং এখানেই রাতের খাবার খেয়ে যাবেন এদের সঙ্গে কথা বলার সময় শুধু দুটি জিনিস আপনি মাথায় রাখবেন এক, আমি এখানে একা পড়ে থাকবো এই আবেগ যেন এদের উন্নতির পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় দুই, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কা্উকে যেন কিছু করতে না হয় বলে তিনি রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন

অমিয়বাবু নি:শব্দে খেতে খেতে ভাবলেন, “মায়েরা ভগবানের অন্য রূপকথাটা যিনি চালু করেছেন তিনি গ্রামের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের এই মায়ের সঙ্গে পরিচিত হলে বা কাছাকাছি এলে বোধহয় কথাটি নিয়ে আরেকবার ভাবতেন কারণ এই মায়ের অসামান্য লড়াইয়ের পরে এই দুটি কথার মানে বুঝলে নিশ্চিতভাবে তিনি এই মাকে ভগবানের উপরে স্থান দিতেন যাই হোক, দুই ভাইয়ের উভয়ের কথা শুনে এবং তাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে, রমেশের প্রবল আপত্তি সত্বেও স্থির হলো যেহেতু নরেশ পরবর্তীকালে গবেষণা করতে চায়, তাই সে কলকাতায় গিয়ে বড়ো কোন কলেজে অনার্স নিয়ে পড়বে এবং তার সব ব্যবস্থা রমেশ করবে অমিয়বাবুর উপরে দুই ভাই কখনোই কোনদিন কোন কথা বলেনি, আজও বললো না রাতের খাবার খেতে খেতে দুই ভাইয়ের সঙ্গে আরো একপ্রস্থ পড়াশোনা নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা করার পরে অমিয়বাবু তার ভাড়াবাড়িতে ফিরে এলেন

নরেশ আর রমেশ দুজনেই কলকাতায় চলে গেলো অমিয়বাবু তার স্কুল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, আর লক্ষীদেবী তার কাজ-কর্ম, বিষয়-আষয় নিয়ে মাঝে মধ্যেই নরেশ এবং রমেশ তাদের মা এবং স্যারকে ফোন করে, কথা বলে নরেশ প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেছে সে মেধাবী এবং পরিশ্রমী, পড়াশোনা ভালোই চলছে কলেজের মেসেই থাকে শিক্ষকেরা মনোযোগী ছাত্র পেয়ে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে

সময়ের স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের ঘটনাবলীর ধারা প্রবহমানতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে অমিয়বাবুর কলকাতার বাড়িতে বৃদ্ধ চাকরটি অসুস্থ হয়ে মারা গেছে, অমিয়বাবু নিজ আত্মীয়ের মতো ছুটি নিয়ে তার সমস্ত পারলৌকিক কর্ম, শ্রাদ্ধ-শান্তি করেছেন রমেশ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশে চলে গেছে ডাক্তারী পাশ করার পরে, তার মেডিক্যাল কলেজের বিভাগীয় প্রধান সমস্ত ব্যবস্থা এবং আর্থিক দিক দেখে নিচ্ছেন, শুধুমাত্র একটি শর্তে বিদেশ থেকে ফিরে রমেশের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে হবে রমেশের সঙ্গে কথা বলার পর লক্ষীদেবী সেই শর্তে রাজি হয়ে গেছেন নরেশ দারূণ রেজাল্ট করে বি.এস.সি পাশ করে এম.এস.সি পড়ছে

আরো কিছু বছর পরে নরেশ গবেষণার জন্য লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক পেয়ে চলে গেছে রমেশ উচ্চশিক্ষার পরে আর দেশে ফেরেনি, আমেরিকার একটি হাসপাতালে সে এখন বিখ্যাত ডাক্তার তার শিক্ষক নিজের মেয়েকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, সেখানেই তারা বিয়ে করেছে   রমেশ মা-কে টাকা পয়সা লাগবে কিনা জানতে চেয়ে ফোন করেছিল, লক্ষীদেবী তাকে টাকা-পয়সা পাঠাতে বারণ করেছেন নরেশ যা পায়, বিনা অনুমতিতে মায়ের জন্য যখন যেরকম পারে, টাকা পাঠায় লক্ষীদেবী তাকেও টাকা-পয়সা পাঠাতে বারণ করেছেন, কিন্তু সেসব কথা শুনেও সে শোনেনি নিয়ম করে সে টাকা-পয়সা পাঠিয়ে গেছে প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে সে তিন থেকে চারবার মা এবং স্যারকে ফোন করে

বড় ভাবনা

অমিয়বাবু আর এক বছর বাদে রিটায়ার্ করে যাবেন তিনি চিন্তা করেন, এরপরে তিনি কি করবেন, সময় কিভাবে কাটাবেন এইসব চিন্তায় তার চুল-দাড়ি আরো পাকতে থাকে এমন সময় তার একজন ছাত্র তাকে এসে খবর দেয়, লক্ষীদেবী তাকে একবার ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি তাকে দিয়ে খবর পাঠালেন, যে সামনের রবিবার তিনি লক্ষীদেবীর কাছে যাবেন

রবিবার এলে তিনি পৌঁছালেন লক্ষীদেবীর কাছে কোনরকম ভনিতা ছাড়াই লক্ষীদেবী বলতে শুরু করলেন, দেখুন অমিয়বাবু আমার ছেলেরা এখন সু-প্রতিষ্ঠিত কিন্তু আমি আমার কাজকে আরো বৃহৎ পরিসরে করতে চাই এইজন্য আপনার সাহায্য দরকার দেখুন, রমেশ আর নরেশের বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি শুধু ওদের মা হয়ে থাকিনি, নিজের কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেছি, সঞ্চয় করেছি, তাই দিয়ে আরো জমি-জমা কিনেছি, জীবনকে কাছে থেকে দেখেছি, মানুষের লড়াইকে দেখেছি এখন আমার ছোট ছেলে আমায় যা টাকা-পয়সা পাঠায়, তাও আমার একার জন্যে বিলাসবহূল জীবনযাপনের জন্যে যথেষ্ট কিন্তু আমার মনে হয়, এইসব অর্থ, জমি-জমা এইসবের সঠিক কাজে লাগানো উচিত আমার রমেশ, নরেশের মতো আরো অনেক সন্তান আছে যারা হয়তো কেউ পিতৃহারা, কেউ মাতৃহারা, কারোর কেউ নেই, আমি তাদের 'মা' হয়ে থাকতে চাই আমি  মাতৃমন্দিরনামে একটি আশ্রম করতে চাই, যেখানে আমার সেইসব সন্তানেরা থাকতে পারবে, তাদের খাওয়া-পরা, থাকা, পড়াশোনার দায়িত্ব আমি নিতে চাই কিন্তু আমি একা এইসব সামলাতে পারবো না, আমি আশা করবো আপনি যেমন রমেশ-নরেশকে অভিভাবকের মতো সামলেছেন, তেমনি মাতৃমন্দির থেকে আরো রমেশ-নরেশ তৈরী করে তুলুন যারা একদিন সমাজের বুকে মাথা উচু করে দাড়াতে পারবে, দেশের ভবিষ্যত হয়ে উঠতে পারবে আপনি ভেবে দেখুন আর আমাকে জানান শুধু্ একটা অনুরোধ এ্ই ব্যাপারে আমার ছেলেদের কিছু জানাবেন না কারণ এই ঘর-বাড়ি, জমি-জমা, সম্পত্তি সব  আমার, তার বাবার সম্পত্তির পরিমাপের সমান অর্থ আমি তাদের দুজনের নামে ব্যাঙ্কে রেখে দিয়েছি আর আমার মনে হয়, তাদের বোধহয় আর এই সম্পত্তির প্রয়োজন পড়বে না   

অমিয়বাবু বাড়ি ফিরে অস্থির হয়ে পড়লেন তার মনে হতে লাগলো, একজন সাধারণ মহিলা কিভাবে অসাধারণ এই ভাবনাটা ভাবতে পারলেন তার মনে হলো, তিনি যেন জীবনের একটি অর্থ খুঁজে পেলেন অথচ কিছুদিন আগেও তিনি অস্থির হচ্ছিলেন যে রিটায়ারের পরে তিনি কি করবেন, কি করে তার সময় কাটবে তার কানে লক্ষীদেবীর কথাগুলো বারবার যেন আঘাত করছিলো – “আমি তাদের মা হয়ে থাকতে চাই এইরকম একটি প্রস্তাবে না বলার কোনরকম যুক্তি তিনি নিজের দিক থেকে খুঁজে পেলেন না আর পরদিনই তিনি তার সম্মতি লক্ষীদেবীকে জানিয়ে দিলেন

মায়ের প্রতিষ্ঠা

বেশ কয়েক বছর পরে নরেশ দেশে ফিরছে সে এখন একজন সু-প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী, বিয়ে-থা করেনি ভাইরাসের জিনের প্রকারভেদ আর তাদের রূপান্তর নিয়ে তার আবিষ্কার তাকে বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলে উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে সারা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডেকে পাঠায়, তার আলোচনা শোনার জন্য এবরে সে মাকে বা স্যারকে জানায়নি যে সে আসছে, সে ভেবে  রেখেছে হঠাৎ এসে সে মাকে এসে চমকে দেবে আর দেশ-বিদেশ থেকে পাওয়া পুরষ্কারগুলো দেখে মায়ের খুশি আর গর্বেভরা মুখটা মনে পড়লে সে নিজের মনেই খুব খুশি হয়

বিমানবন্দর থেকে সোজা গাড়ি নিয়ে নিজের বাড়ির সামনে এসে দাড়িয়ে নরেশ নিজেই চমকে ওঠে তাদের সেই বাড়ির বদলে দাড়িয়ে রয়েছে এক আশ্রম – “মাতৃমন্দির আশ্রমের সামনে বাগানে একটি গাছের নীচে অমিয়বাবু কিছু ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছিলেন গাড়ি দেখে বাচারা ছুটে এলো নরেশ স্যারকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো আর জিজ্ঞাসা করলো এসব কি স্যার ? অমিয়বাবু তাকে বললেন ভিতরে চলো, মায়ের সঙ্গে দেখা করো, সব জানতে পারবে

ভিতরে গিয়ে দেখতে পেলো মা একদম ছোট ছোট কয়েকজন শিশুকে পরম স্নেহে নিজের হাতে জলখাবার খাওয়াচ্ছেন সে ছুটে গিয়ে মাকে প্রণাম করে জড়িয়ে ধরে ছোট শিশুর মতো কাঁদতে লাগলো কিছু পরে একটু সামলে উঠে বললো, তোমাকে কিছু বলতে হবে না মা আমি সব বুঝতে পেরেছি, শুধু একটু দেরী হয়েছে মা তোমায় বুঝতে বিদেশে আমি ভাবছিলাম যে আমি অনেক বড় বিজ্ঞানী হয়ে গেছি, কিন্তু এখানে এসে দেখতে পেলাম, বুঝতে পারলাম যে, মা তুমি আমাদের থেকে অনেক অনেক বড় আজ আমি তোমায় কথা দিচ্ছি যে আমি প্রচুর টাকা উপার্জন করি, আর আরো করবো আর তোমার এই মহান ব্রতের মাধ্যমে আমি তোমায় মা করেই রাখবো তোমায় আমি কথা দিচ্ছি যে, এই মাতৃমন্দির-য়ের দায়িত্ব আজ থেকে আমি নিলাম । তোমার-আমার পরেও যেন এই “মাতৃমন্দির” অনেক অনেক বছর ধরে চলতে পারে তার ব্যবস্থা আমি করে যাবো তুমি সবার মা হয়েই থাকবে তোমার “মাতৃমন্দিরে” সবার মনে, সবার স্মৃতিতে, তোমায় ছুঁয়ে কথা দিলাম           

 

এই গল্প আমাদের শেখায় যে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যে সন্তানের জীবনে মায়ের ভূমিকা, মায়ের সংগ্রাম, আত্মসম্মানবোধ, আত্মত্যাগ, ছাত্রের জীবনে শিক্ষকের ভূমিকা, অধ্যবসায়, লড়াই, ক্ষুদ্র স্বার্থের উপরে উঠে কিছু করার প্রয়াস, সামাজিক দায়বদ্ধতা একজন সাধারণ মানুষকে কিভাবে মহান/মহীয়সী করে তুলতে পারে।

গল্প পড়ে কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন, আপনার কিছু একটা কমেন্ট আপনার উপস্থিতি জানান দেয়, জানায় যে, আপনারা সঙ্গে আছেন । যা আমায় উৎসাহিত করে জীবনের দৈনন্দিতার ফাঁকে ফাঁকে নতুন করে কিছু ভাবার, কিছু লেখার । আশাকরি, সঙ্গে থাকবেন ।

আরো গল্প পড়ুন :- ছোট গল্পভূতের গল্প 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ