বাংলা রহস্য গল্প : গোয়েন্দা বিভাগের বড় অফিসার রাজীব দত্ত গাড়ি থেকে নেমেই সামনের বিশাল বাংলোটাকে একবার উপরে থেকে নীচে পর্যন্ত দেখে নিলেন । সাদা রঙের বিশাল দোতলা বাংলো, চারপাশে সুন্দর সাজানো গোছানো বাগান । দেখলেই বোঝা যায় রোজ গাছগুলোর পরিচর্যা করা হয় । গাড়ি বারান্দায় দাঁড় করানো রয়েছে একটা বড় মাপের দামী গাড়ি । চারপাশটা দেখলেই বোঝা যায়, এই বাড়ির মালিকের টাকার পরিমাণ কতোটা হতে পারে । শান্তিনিকেতনের এই এলাকাটায় এরকম দৃষ্টিনন্দন বাংলো অনেক রয়েছে, কিন্তু আজ এই বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন বাংলো থেকে অন্ধকার একটা আভা ছড়াচ্ছে।
শান্তিনিকেতন রহস্য : অমলেন্দু দত্তের ডায়েরী
একটি রহস্যময় মৃত্যু
লোকাল থানার ও.সি শ্রীমন্ত চক্রবর্তী
এগিয়ে এসে স্যালুট দিলেন । "গুড মর্নিং স্যার, মৃতদেহটা রয়েছে উপরের শোওয়ার ঘরে । নাম
অমলেন্দু বিকাশ দত্ত । ভদ্রলোক একাই থাকতেন, স্ত্রী-পুত্র
নাকি আগেই মারা গেছে । বয়স মোটামুটি ৬৫-৬৬ হবে । স্থানীয়ভাবে খুব সন্মানিত ব্যক্তি,
প্রচুর দান-ধ্যান করেন, বাড়িতে অনেক কাজের লোকজন । তবে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে আত্মহত্যার ঘটনা । মাথায় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক থেকে গুলি করা হয়েছে । বাড়ির কাজের লোকেরা আজ সকালে দরজা খোলা না পেয়ে
ভেঙে ঢুকেই প্রথম দেখে এবং পুলিশে খবর দেয় ।"
রাজীব দত্ত একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললেন । আত্মহত্যা ?
এতো টাকা, এতো
বড় বাড়ি-গাড়ি, এতো সম্মান—তারপরও আত্মহত্যা ? তিনি
চারদিকটা দেখতে দেখতে ধীর পায়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন । বাড়ির ভিতরে অনেক ঘর, বিশাল জায়গা । অভিজাত
ফার্নিচার, দামী পেন্টিং, রুপোর থালাবাসন—সম্পদ
যেন ঠিকরে পড়ছে । কিন্তু অদৃশ্য একটা ভারী-বিষণ্ণ ভাব সব জায়গায় ।
উপরের শোওয়ার ঘরে অর্থাৎ অকুস্থলে পৌছে
তিনি নিদারুণ একটি দৃশ্য দেখলেন । একজন বয়স্ক মানুষ সুন্দর করে গোছানো বিছানায়
শুয়ে আছেন, পাশেই পড়ে রয়েছে একটা রিভলবার । মাথার পাশের রক্তের দাগ বিছানার চাদরে পড়ে
শুকনো হয়ে গেছে । মানুষটার চোখ দুটো খোলা, আকাশের দিকে চেয়ে
রয়েছে । সেই খোলা চোখে মিশে রয়েছে ভয়
আর আতঙ্ক ।
ঘরটায় ইতস্তত: ঘুরতে ঘুরতে রাজীবের নজর
পড়লো বিছানার পাশে ছোট্ট ওয়ালটেবিলের উপর রাখা একটি ডায়েরীর উপর । চামড়ার বাঁধাই, সুন্দর আর দামী একটা ডায়েরী । তিনি সাবধানে ডায়েরিটি উঠিয়ে নিলেন । ডায়েরীর প্রথম
পাতাটা খুলে তিনি দেখলেন, সুন্দর সোনালি
অক্ষরে নাম লেখা—"অমলেন্দু বিকাশ দত্ত"।
হয়তো এই ডায়েরীই উত্তর দেবে সব
প্রশ্নের । তিনি ডায়েরীটা নিজের কাছে রেখে দিলেন ।
তারপরে আরো একটু বাড়ির এদিক-ওদিক
ঘোরাঘুরি করলেন । বাড়ির কাজের লোকদের রুটিন-মাফিক কিছু প্রশ্ন করলেন । ফরেনসিক
বিভাগের লোকজন তাদের কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছেন । একটু-আধটু ঘোরাঘুরি করলেন । শোওয়ার
ঘরের ড্রেসিং টেবিলের বড় কাঁচটা ভাঙা দেখে তিনি জানতে চাইলেন, কাঁচটা কবে ভেঙেছে
এবং কি করে ? কাজের লোকরা কিভাবে ভেঙেছে তার সঠিক জবাব দিতে পারলো না । শুধু
জানালো দিন-দুয়েক আগে তারা সকালে কাজে এসে দেখলো কাচটা ভেঙেছে । সারানোর জন্যে
অমলেন্দুবাবু লোককে খবরও পাঠিয়েছেন, সে এখনো এসে পৌঁছানোর আগেই এই ঘটনা ঘটে গেলো ।
সেই বাড়িরই ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে তিনি
ডায়েরীটার পাতা ওল্টাতে শুরু করে দিলেন ।
ডায়েরির পাতায় অমলেন্দুর কথা
ডায়েরি, পাতা নং - ১
১০ই অক্টোবর, ২০২৩
কোনদিন ডায়েরী লিখিনি, কিন্তু আজ থেকে
এই ডায়েরী লিখতে শুরু করলাম । হয়তো এটাই আমার একমাত্র সাথী, যাকে আমি আমার সব কথা
জানাতে পারি । আর ভিতর থেকে কেন যেন তাগিদও অনুভব করছিলাম, আমার কথাগুলো লিখে
যাওয়ার জন্যে । যদিও কোনদিনই লেখালিখি করিনি, শুধু প্রচুর টাকা রোজগার করার
ফন্দি-ফিকির খুজেছি । কিন্তু তবুও কিছুদিন ধরেই আমার কাউকে কখনো না-বলা কথাগুলো
লিখে যাওয়ার জন্যে একটা তাগিদ অনুভব করছিলাম ।
শান্তিনিকেতনে আসার পর থেকেই মনে
হচ্ছিল, কোলকাতা থেকে পালিয়ে এলেও আমার প্রথম জীবনের করা পাপগুলো আমার পিছু নিয়েছে
। কোলকাতার সেই সব স্মৃতি, সেই সব মানুষগুলো—তারা সব আমার সঙ্গে সঙ্গেই এসে পৌঁছেছে
শান্তিনিকেতনেও । এখন বুঝতে পারছি যে, পাপ কখনও পিছু ছাড়ে না ।
এই বিশাল বাংলো তৈরী করেছিলাম অর্চনা
আর রোহনের জন্য । ভেবেছিলাম,
প্রকৃতির মধ্যে থাকলে তারা সুখে থাকবে । অর্চনা খুব খুশিও হয়েছিলো এ্খনে এসে । সে বলেও ছিলো, "মনে
হচ্ছে এখানে এসে আমাদের পুরনো সব গ্লানি ধুয়ে-মুছে যাবে।" কিন্তু
হায়, নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস ! আমার করা পাপের জন্যে
তাকেই এই পৃথিবী থেকে আগে কষ্টদায়ক ভাবে চলে যেতে হলো । এখন সব কিছুর জন্যেই
নিজেকে দায়ী মনে হয় । কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই, অপেক্ষা করা ছাড়া । হয়তো সেই
সময়ও কাছে চলে এসেছে, কারণ তারা চলে এসেছে । যেকোন দিন, যেকোন মূহুর্তে তারা
ঝাপিয়ে পড়বে আমার উপর, তাই হঠাৎ চলে যাওয়ার আগে সব কিছু লিখে রেখে যেতে চাই ।
ডায়েরি, পাতা নং - ২
১১ই অক্টোবর, ২০২৩
আজ রাতে হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল সুরেশ আগরওয়ালের কথা । সে একজন ছোটখাটো ব্যবসায়ী ছিলো । কিন্তু আমি তাকে বোঝালাম, একটা বড় প্রজেক্টে বিনিয়োগ করার জন্য । তাকে বিপুল লাভের লোভ দেখালাম । সে তার স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে, বাড়ি বন্ধক রেখে ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল ঋণ নিয়ে আমার হাতে টাকা তুলে দিলো । আর আমি সেই টাকা দিয়ে শান্তিনিকেতনের এই জমি কিনলাম, বিশাল বাংলো বানালাম । সুরেশ যখন টাকা চাইতে শুরু করলো, আমি তাকে হুমকি দিলাম, জাল দলিল দেখালাম যে সে আমার কাছে ঋণগ্রস্ত । একদিন সকালে খবর পেলাম, সে নিজের ফ্ল্যাট থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে । তার স্ত্রী দুই শিশুসন্তান নিয়ে রাস্তায় বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিলো । আসলে আজ রাতে আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম করিডোরে সুরেশের কণ্ঠস্বর । সে কঠিন স্বরে বলছিল, "আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ ফেরত দাও, অমলেন্দু..."
ডায়েরি, পাতা নং - ৩
১২ই অক্টোবর, ২০২৩
হয়তো আমার জীবনের করা সবচেয়ে বড় পাপ
ছিল অরুণ দাসের সাথে । সে ছিলো একজন আদর্শশীল স্কুলশিক্ষক ।
তার বাবার সারা জীবনের করা সঞ্চয় দিয়ে কেনা একটা ছোট্ট জমি ছিল, যেখানে
তার পরিবারের সবার স্মৃতি জড়িত ছিলো । আমি
সেটা দখল করতে চেয়েছিলাম একটা শপিং মল বানানোর জন্য । সে রাজি না হওয়ায়, আমি
একদিন কিছু গুন্ডা ভাড়া করে তার বাড়িতে ঢুকিয়ে দিলাম । তারা অরুণকে মারধর করলো, তার
স্ত্রীকে খুবই বাজেভাবে অপমান করলো । এর
কয়েকদিন পরই লজ্জায় অরুণের স্ত্রী
আত্মহত্যা করলেন । অরুণ পাগলপ্রায় হয়ে গেল । আর আমি সেই সুযোগে নকল কাগজপত্র বানিয়ে তার জমি
দখল করে নিলাম । বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে তাকে আমি শান্তিনিকেতনের রাস্তায় ভিক্ষা করতে
দেখেছি । সে আমায় চিনতে পেরেছিলো আর রাস্তায় আমার সামনে চিৎকার করে বলছিলো, “তুমি
আমার জীবন ধ্বংস করেছো, আমিও তোমায় ধ্বংস করবো ।“ কিন্তু শান্তিনিকেতনের লোক আমার
অর্থের কথা জানে, আমায় সম্মান করে । তাই লোকে তাকে পাগল বলেই ধরে নিয়েছিলো । আমিও
তাকে না চেনার ভান করেছিলাম । সে কি করে শান্তিনিকেতনে এলো, তারপরেই বা কোথায় গেলো
আর কিছুই জানতে পারিনি । কিন্তু বিগত কয়েকদিন ধরেই যেন তারও অশরীরী অস্তিত্বের কথা
টের পাচ্ছি ।
এইরকম আরো দু-তিন জনের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি । যাদের সঙ্গে আমি কখনো না কখনো প্রতারণা করেছি, তাদের ধোঁকা দিয়েছি । শুধু প্রচুর প্রচুর অর্থ করার জন্যে । প্রচুর ধনী হওয়ার জন্যে । আসলে আমার ধারণা ছিলো, প্রচুর অর্থ ছাড়া জীবনে সুখ পাওয়া সম্ভব নয় । আজ তারা সবাই এসে উপস্থিত হয়েছে এই শান্তিনিকেতনে । হয়তো আমার নিয়তিই তাদের টেনে নিয়ে এসেছে এখানে । বুঝতে পারছি শুধুমাত্র একটা সুযোগ, তাহলেই তারা আমায় ছিঁড়ে ফেলবে ।
ডায়েরি, পাতা নং - ৪
১৩ই অক্টোবর, ২০২৩
আমার অর্চনা... আমার রোহন... তাদের কথা মনে হলে আজও যেন আমার বুকটা ফেটে যায় । আমরা শান্তিনিকেতনে আসার ছয় মাস পরেই অর্চনার ক্যানসার ধরা পড়লো । ডাক্তাররা বললেন, এটা এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে যে কিছু করার নেই। আমি তাকে মুম্বইতে নামী ক্যানসার হসপিটালে, এমনকি বিদেশেও নিয়ে গেলাম । কিন্তু কিছুতেই তাকে বাঁচাতে পারলাম না । তার শেষ কথা ছিল, "অমল, আমি জানি না তুমি কার কার সঙ্গে কী কী করেছো, কিন্তু ঈশ্বর যেন তোমাকে ক্ষমা করেন ।" তার মৃত্যুর এক বছর পরেই, রোহন একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলো । সে বন্ধুদের সাথে বোলপুরে যাচ্ছিলো । পুলিশ বলল, গাড়ির ব্রেক কাজ করেনি । কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সেটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, কারণ সেই দুর্ঘটনায় রোহন ছাড়া আর কারো মৃত্যু ঘটেনি । এটা শুধুমাত্র আমার পাপের ফল । আমি আমার পরিবারকে হারিয়েছি, কারণ আমি কোন এক সময়ে অন্য কাউকে তার পরিবার হারাতে বাধ্য করেছি । নিরূপায় হয়ে পরিবারকে ছেড়ে আত্মহত্যার রাস্তা বেছে নিতে বাধ্য করেছি । তাই বোধহয় ঈশ্বরও আমায় পরিবার ছাড়ার দু:খ বুঝিয়ে দিলেন ।
ডায়েরি, পাতা নং - ৫
১৪ই অক্টোবর, ২০২৩
আজ একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটলো । আমি রাতের খাবার খেয়ে আমার লাইব্রেরীতে বসেছিলাম । কাজের লোকেরা সবাই বাড়ি চলে গিয়েছিলো । হঠাৎ করেই ঘরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলো । আমি ঠান্ডায় কাঁপতে শুরু করলাম । তারপর আমার চোখের সামনেই বইয়ের আলমারি থেকে সব বই নিজে নিজেই মেঝেতে পড়তে শুরু করল । অদৃশ্য কেউ যেন টেনে টেনে বইগুলো মেঝেতে ফেলে দিচ্ছে । আমি দেখলাম, আমায় ঘিরে মেঝেতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা দিচ্ছে—একটা, দুটো, তিনটা, তারপরে অজস্র – আর তারপরে হঠাৎ সেগুলো দুরন্ত গতিতে জড়ো হয়ে মেঝের উপরে একটা শব্দে পরিণত হলো—"হত্যাকারী"।
আমায় ঘিরে অসংখ্য মানুষ যেন ফিসফিস করে
বলতে লাগলো, “খুনি”, “হত্যাকারী” । আমি ভয়ে চিৎকার করতে গেলাম, আমার গলা দিয়ে কোন
স্বর বেরোল না । কোনরকমে দৌড়ে আমি আমার শোওয়ার ঘরে গেলাম । কিন্তু সেখানে, ঘরে
ঢুকেই ড্রেসিংরুমের বড় আয়নায় চোখ পড়তেই আমি নিজেকে দেখলাম না । দেখলাম সুরেশ আগরওয়ালকে, তার
মুখমণ্ডল বিকৃত করে সে হাসছিলো । আর
পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো অরুণ দাসের পাগল স্ত্রী । আমি আয়নার দিকে আমার পায়ের একটা স্লিপার ছুঁড়ে
মারতেই আয়নাটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো । আর পলকের
মধ্যেই সারা ঘর, বাড়িটা কেমন যেন নিস্তব্ধ-নিশ্চুপ হয়ে গেলো । বাইরেও যেন কোথাও,
কোন আওয়াজ পাওয়া যচ্ছিলো না ।
ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে একটা কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লাম । ভয়ে আলো বন্ধ করতে পারলাম না । প্রায় অর্ধেক রাত অবধি জেগে থেকে এই ডায়েরীতে সব লিখলাম । তারপরে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম ।
ডায়েরি, পাতা নং - ৬ (শেষ পাতা)
১৫ই অক্টোবর, ২০২৩
আজ সকাল থেকেই প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে
। চারিপাশটা অন্ধকার হয়ে আছে, দিনের বেলাতেও আলো জ্বালাতে হচ্ছিলো । কাজের লোকেরাও
অনেকেই আসেনি । যে কয়েকজন এসেছিলো তারা আমার রান্না-বান্না, অন্যান্য কাজ সেরে
আমার কাছে ছুটি চেয়ে নিয়ে চলে গিয়েছে ।
তারা চলে যাওয়ার পর থেকেই আমি আজ অন্য
অনেকের ঘোরাফেরা টের পাচ্ছি । কখনো তারা ছায়ার মতো আমার চোখের সামনে দিয়ে, কখনো
পিছন দিয়ে দ্রুত গতিতে সরে যাচ্ছে । কখনো বাড়ির অন্য ঘরে কোন জিনিস ফেলে দিয়ে
তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে । কখনো আমার চারপাশেই অদৃশ্য কারোর ফিস-ফাস শুনতে
পাচ্ছি । হয়তো তারা ঠিক করেই নিয়েছে আজ তারা আমায় শেষ করে ছাড়বে ।
রাত বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের
ঘোরাফেরা বাড়তে লাগলো । কখনো মনে হচ্ছিলো আমায় ঘিরে তারা যেন গোল করে ঘুরছে । কখনো
একই সঙ্গে রান্নাঘরে বাসন-পত্র পড়ছিলো, আবার লাইব্রেরীর ঘরে পড়ছিলো বইপত্র । কখনো
আমার চোখের সামনেই খাওয়ার জলের বোতলটা টেবিল থেকে শূন্যে উঠে ভেসে গিয়ে নীচে পড়ে
যাচ্ছিলো । আবার কখনো ড্রয়িংরুমে যেন অনেক
মানুষ একসঙ্গে ধুপধাপ করে আওয়াজ করছিলো ।
আমি বুঝতে পারছিলাম আমার সময় ঘনিয়ে
আসছে । রাত দশটা বাজেনি এখনো, সারা রাত পড়ে রয়েছে । আজ তারা আমায় পাগল করে ছাড়বে,
তারপরে আমায় ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলবে !
কিন্তু আমি আমার মনস্থির করে ফেলেছি ।
ধীরেসুস্থে রাতের খাবার খেয়ে, আমি আমার শোওয়ার ঘরে চলে এলাম । আমি আমার বিছানার
পাশের ডেস্কের ড্রয়ারটা খুললাম । ভিতরে
রাখা আছে আমার সেই পুরনো রিভলবার । একদিন
এটাই ছিলো কলকাতায় আমার আত্মরক্ষার অস্ত্র, সাহস । কে জানতো, আজ এটাই হয়ে উঠবে আমার মুক্তির
মাধ্যম?
চলে যাওয়ার আগে আমি এই ডায়েরীতে আমার
গল্পটা লিখে রাখলাম । হয়তো কেউ একদিন এটা পড়বে এবং বুঝবে—টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, সম্মান—কিছুতেই
প্রকৃত শান্তি কিনে আনা যায় না । শান্তি
একমাত্র পাওয়া যায় তখন, যখন আপনার আত্মা প্রকৃত শান্তিতে থাকে ।
এবার সময় হয়েছে চলে যাওয়ার । আমি বিশ্বাস করি, মৃত্যুর পরও কিছু থাকে। হয়তো সেখানে গিয়ে অর্চনা আর রোহনের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিতে পারবো । আর যাদের আমি ক্ষতি করেছি, তাদের কাছেও । শুধু একটা অনুরোধ, আমার এই বাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করে যাদের আমি ক্ষতি করেছি তাদের যতোটা সম্ভব যেন ক্ষতিপূরণ করা হয় । সমস্ত তথ্য, বাড়ির কাগজপত্র ইত্যাদি আমার লাইব্রেরীর লকারে রাখা আছে । আর লকারের চাবি রাখা আছে আমার ড্রেসিংরুমের ড্রয়ারে ।
বিদায়। চিরকালের জন্য বিদায়।
- অমলেন্দু বিকাশ দত্ত
তদন্তের সমাপ্তি
রাজীব দত্ত ডায়েরীটা বন্ধ করলেন, আর তিনি
চোখ বুঁজে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলেন । থানার ও.সি শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে
তাকালেন তার দিকে আর প্রশ্ন করলেন-
"কি লেখা আছে, স্যার?"
রাজীব দত্ত ডায়েরীটা তাঁর হাতে তুলে
দিলেন । "একটা আত্মস্বীকারোক্তি। অমলেন্দু দত্ত
আত্মহত্যা করেছেন, এতে কোন সন্দেহ নেই । কিন্তু এটা কোন সাধারণ আত্মহত্যা নয়। এটা এক
ধরনের... প্রায়শ্চিত্ত ।"
"প্রায়শ্চিত্ত?"
"হ্যাঁ। তিনি মনে করতেন, তাঁর অতীতের করা পাপগুলো তাঁকে তাড়া করছে। তিনি তাঁর স্ত্রী ও পুত্রের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করতেন। এই ডায়েরিটাই এর প্রমাণ।"
রাজীব দত্ত অমলেন্দু বিকাশের বাংলোটা থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে একবার পিছনে ফিরে বাড়িটার তাকালেন । সাদা বাংলোটায় ধীরে ধীরে সন্ধ্যার ছায়া পড়ছিলো । দেখে কেমন যেন অন্যরকম একটা অন্যরকম অনুভূতি জেগে ওঠে । তিনি ভাবলেন, মনে মনে মনে তিনি যা ভাবছেন, তা কি সত্যিই ? নাকি আসলেই কোন অদৃশ্য সত্যি লুকিয়ে আছে এই ঘটনায় ?
তিনি ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠে বসলেন আর ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন কোথায় যাবেন । হয়তো আজ রাতে তাঁরও ঘুম হবে না । কারণ, এই ডায়েরীর মাধ্যমে তিনি ঢুকে পড়েছিলেন অন্য একজন মানুষের মনে । আর সেখানে তিনি অনুভব করেছেন শুধুই আত্মগ্লানি, অশরীরী অস্তিত্ব আর মৃত্যুর কালো হাতছানি ।

0 মন্তব্যসমূহ