বাংলা প্রেমের গল্প : সুমন আর মনীষা ছোটবেলার বন্ধু । একই পাড়ায় তারা ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে উঠেছে । বলতে গেলে তারা প্রতিবেশী । সুমনদের বাড়ি থেকে তিনটে বাড়ি পরেই মনীষাদের বাড়ি । ছোটবেলায় একই সঙ্গে দু’জনে পুতুল নিয়ে খেলেছে । কখনো সুমনদের বাড়িতে, কখনো বা মনীষাদের বাড়িতে খেলনা বাটি নিয়ে তারা সংসার পাততো । দু’জনে একই সঙ্গে একই স্কুলে ভর্তি হয়েছে । কখনো বা মনীষার বাবার হাত ধরে, আবার কখনো বা সুমনের বাবার হাত ধরে দু’জনে একসঙ্গে স্কুলে গেছে ।
বাংলা প্রেমের গল্প : কিছু না বলা কথা .....
স্কুল জীবন ও বেড়ে ওঠা
ক্লাস ফোরের পরে ফাইভে ভর্তি হওয়ার জন্যে মনীষা চলে গেছে গার্লস স্কুলে । সুমন রয়ে গেছে বয়েজ স্কুলে । আসলে প্রাথমিক বিভাগটা ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে সকালে বয়েজ স্কুলেই হতো । আর ক্লাস ফাইভ থেকে মেয়েরা গার্লস স্কুলে চলে যেতো । যদিও গার্লস স্কুলটা ছিল সুমনদের বাড়ির আরো কাছে । আর বয়েজ স্কুলে যেতে হলে কিছুটা দূরে যেতে হতো । কিন্তু তাতে সুমন আর মনীষার বন্ধুত্ব কমেনি, বরং বেড়েছে । একই সঙ্গে টিউশন পড়া, একই সঙ্গে বেড়ে ওঠা । আর সেই বেড়ে ওঠার মধ্যে জীবনের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কৌতূ্হল, ঔৎসুক্য শেয়ার করার মধ্যে দিয়ে দু’জনের বোঝাপড়া আরো বেড়ে গিয়েছিলো । সব থেকে বড়ো কথা দু’জনের পরিবার থেকেই দুই বাড়িতে যাতায়াত, মেলামেশায় কখনো কোন আগল ছিলো না । অনায়াসেই তারা একে অপরের বাড়িতে, এমনকি ঘরেও যাতায়াত করতে পারতো ।
কলেজ জীবন ও দূরত্ব
মাধ্যমিক পাশ করার পরেও তারা একই বিষয় নিয়ে একই স্কুলে দু’জনে ভর্তি হলো । ফলে সেই বয়:সন্ধির সময়টায় যখন ছেলে-মেয়েরা অন্য বন্ধু খোঁজার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো, সুমন আর মনীষার মধ্যে সেইসবের কোনরকম আকর্ষণ আসেনি । তারা সহজেই একে অপরের বন্ধু হিসাবে মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা করতো, একে অপরকে পড়াশোনায় সাহায্য করতো । বন্ধুর অভাব তাদের কখনো হয়নি । দু’জনেই উচ্চ-মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে পাশ করে গেলো ।
এরপরে তাদের দু’জনের পৃথক হওয়ার পালা এলো । কারণ দু’জনে আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে দু’টি আলাদা কলেজে সুযোগ পেলো । কিন্তু সময় পেলেই তারা একে অপরের বাড়িতে চলে আসতো । গল্প করতো, করতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা । এমনকি মনীষার জীবনে একজন অন্য ছেলে আসলো, তার কথাও তারা দু’জনে আলোচনা করতো । সুমনের কলেজের কয়েকজন মেয়েকে ভালো লাগতো, কিন্তু সুমন কখনো তাদের উপরে আকৃষ্ট হয়নি, তাই শুধু বন্ধুত্ব ছাড়া তাদের সঙ্গে অন্য কোন আলাদা সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি । কিন্তু সমস্ত ব্যাপার নিয়েই তাদের দু’জনের মধ্যে আলোচনা হতো । কখনো টুকটাক খুনশুটি-ঝগড়াঝাটিও হতো, আবার মিটেও যেতো ।
কলেজ পাশ করার পরে সুমন অন্য রাজ্যে চলে গেলো পড়াশোনার জন্যে । আর মনীষা কর্মমুখী কিছু কোর্স করার জন্যে ভর্তি হলো একটা ইনস্টিটিউটে । সুমন ব্যস্ত হয়ে পড়লো, মনীষার সঙ্গে কথা বলা কমে যেতে লাগলো । ফোনে কথা হতো, কিন্তু অতো ঘন ঘন আর হতো না । আসলে দু’জনেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো জীবন যুদ্ধে । কিন্তু তবুও বন্ধুত্বের গভীরতাটা কমে যায়নি । মনীষা কোন সমস্যায় পড়লেই সুমনকে হোয়াটস অ্যাপে জানিয়ে দিতো যে সে রাতে কল করবে । আর সুমনকে ফোনে সব জানাতে না পারলে তার শান্তি হতো না । সুমন যখন বাড়ি ফিরতো, তখন মনীষাদের বাড়িতে আগের মতোই যাতায়াত করতো ।
প্রাপ্তবয়স্ক জীবন ও চ্যালেঞ্জ
মনীষার ব্রেক-আপ হয়ে গেছে । সুমনের সঙ্গে কথা বলার জন্য সে ছটফট করছে । কিন্তু সুমনের পরীক্ষা চলছে, তাই সে আগেই বলে রেখেছে গোটা সপ্তাহ তার ফোন বন্ধ থাকবে । মনীষা হোয়াটস্ অ্যাপে মেসেজ করে রেখেছে । তাই সে অপেক্ষা করছে কবে সুমন তাকে কল করবে । সপ্তাহের শেষ দিকে শনিবার সুমন তাকে রাতে কল করলো । মনীষা তাকে সব কিছু কেন হয়েছে, কি জন্যে হয়েছে খুঁটিয়ে বললো ও বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলো । সুমন তাকে অনেক কথা বলার পরে বোঝালো, জীবনের যে সময়টার মধ্যে দিয়ে এখন তারা যাচ্ছে, সেই সময়টা আবেগে ভেসে নষ্ট করার সময় নয়, এখনই সঠিক মনোযোগ দিয়ে জীবনটা গড়ে তোলার সময় । যা হয়ে গেছে সেটা আর ফেরত আসবে না, এখন সামনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে চলতে হবে । জীবনটাকে গড়ে তুলতে হবে আর দেখিয়ে দিতে সেই সমস্ত মানুষগুলোকে, যারা হয়তো ভাবছিলো তারা কিছু করতে পারবে না । তুইও দেখিয়ে দে, জীবনে যে বা যারা তোকে রিজেক্ট করছে, যে তুইও কিছু করতে পারিস । তুইও নিজের ক্ষমতায় নিজেকে নিজের পা্য়ে দাঁড় করাতে পারিস, তুই নিজের উপরে নির্ভর করিস, অন্য কারোর উপরে নয় ।
সুমনের কথাগুলো শুনে মনীষা যেন একটা ভরসা, একটা রাস্তা পেলো । সে ভাবছিলো তার জীবন শেষ হয়ে গেছে, জীবনে সে আর কিছু করতে পারবে না বা করতে চায় না । কিন্তু সুমনের কথাগুলো শোনার পরে তার মনে হলো, সত্যিই তো, সে কেন থেমে যাবে? যখন এই পৃথিবীর কেউ থামছে না । তাহলে সে কেন ? না, সে এগিয়ে যাবে । দেখবে জীবন তার জন্যে সামনে কি রেখেছে । নতুন উদ্যোগে সে আবার ইনস্টিটিউটে যাওয়া আসা শুরু করলো । পড়াশোনা করতে লাগলো নতুন উদ্যমে, নতুন লক্ষ্য নিয়ে । আর যখনই ক্লান্ত লাগতো একঘেয়ে জীবনে, মনে হতো যে অবসাদ তাকে ঘিরে ধরছে, সে সুমনের শরণাপন্ন হতো । সুমন তার সঙ্গে গল্প করতো, তাকে মোটিভেট করতো এগিয়ে যাওয়ার জন্যে ।
বছর খানেক পরে মনীষা একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি পেয়ে গেলো । বেশ ভালো মাইনে, বিদেশের বহু জায়গায়, বিশেষত: ইউরোপের অনেক জায়গায় তাদের অফিস রয়েছে । মনীষা দারূণ এক্সাইটেড, সে রাতে সুমনকে ফোন করলো । সুমন সব শুনে তাকে কনগ্র্যাচুলেশন জানালো । কিন্তু ফোনটা ছাড়ার পরে মনীষার খারাপ অনুভূতি হতে লাগলো, কারণ সুমন তখনো কোন ভালো চাকরী পায়নি । যা পেয়েছে, তার জন্যে সুমনের এতো পড়াশোনার দরকার ছিলো না । আর বাইরে কোন রোজগার ছাড়া থাকতে তাকে বেশ কষ্ট করে চালাতে হয় । বাড়ি থেকে তাকে যা টাকা পাঠায়, তাতে তার কুলায় না, তাই সুমন বেশ কয়েকটা টিউশনি করে । তার বাবা-মা অনেক বার তাকে চলে আসতে বলেছে, কিন্তু সুমন রাজি হয়নি । কারণ তার মতে, সেখানে থাকতে গেলে তাকে যে কষ্ট করতে হয় সেটার জন্য নয়, সেটাকে সে তার ভালো চাকরী পাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি বলে নিজেকে ও পরিবারকে বুঝিয়েছে । তার যুক্তিতে সেখানে থাকতে গেলে, তাকে সবার সাথে, তার ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সবসময় ইংরাজীতে কথা বলতে হয় । সুমন বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেছে, তাই ইংরাজীতে এই কথা বলাকে সে তার প্রস্তুতির অংশ হিসাবেই দেখেছে ।
কয়েক মাস পরে সত্যিই সুমন একটা বিদেশী কোম্পানীতে খুব ভালো একটা চাকরী পেয়ে গেলো । সুমনদের বাড়িতে খুশির ঝড় বয়ে গেলো । চাকরী পাওয়ার ১৫ দিন পরেই তাকে জার্মানীতে সেই কোম্পানীর হেড-অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো বিশেষ ট্রেনিংয়ের জন্যে । বিদেশ যাওয়ার আগে সুমন একবার শুধু বাড়িতে ঘুরে গিয়েছিলো । তখনই মনীষার সঙ্গে তার অনেক কথা হয়েছিলো ।
সুমন বিদেশ চলে গেছে । মনীষার সঙ্গে তার যোগাযোগ অনেক কমে গেছে । দু’জনেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । বাড়িতেও সুমন খুব কম ফোন করে । ট্রেনিং শেষ হওয়ার পরে সুমনকে কোম্পানী হেড-অফিসেই রেখে দিয়েছে । এই ব্যাপারে সে বাড়িতে ফোন করে যা জানিয়েছে, তা হলো কোম্পানী তার কাজে খুবই খুশি । তাই তারা সুমনকে বেঙ্গালুরুতে শুধুমাত্র একজন কর্মচারী হিসাবে পাঠাতে চায় না । খুব শিগগিরি তারা ওড়িশার ভুবনেশ্বরে আরেকটা অফিস খুলতে চায় । আর সেই অফিসের দায়িত্ব তারা সুমনের উপরে দিতে চায় । তাই যতোক্ষণ না ওড়িশাতে অফিস হচ্ছে, ততোক্ষণ তারা তাকে হেড-অফিসে রেখে তাদের কোম্পানীর সমস্ত কিছু তাকে শিখিয়ে-জানিয়ে দিতে চায় ।
একটি ট্র্যাজেডি
আসলে জীবন এরকমই - কর্মজীবনের ব্যস্ততা, গতে বাঁধা জীবনের রুটিনে সমস্ত আবেগ, স্মৃতি, সমস্ত কিছুই যেন ধীরে ধীরে মলিন হতে থাকে । তাই সুমন আর মনীষার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না । সময়ের নিয়মে আর বাড়ির চাপে মনীষার বিয়ে হয়ে গেলো । কিন্তু সুমন জার্মানী থেকে তার বিয়েতেও আসতে পারলো না । কিছুটা অভিমানে, কিছুটা রাগে, কিছুটা ব্যস্ততায়, মনীষা সুমনের সঙ্গে প্রায় একদমই আর কোন যোগাযোগ রাখলো না । কিন্তু মনীষার বিয়েটা টিকলো না । বিয়ের দু’বছর না ঘুরতেই মনীষা আর তার স্বামী শরণাপন্ন হলো কোর্টের – ডিভোর্সের জন্য । আসলে মনীষার স্বামী ভালো রোজগার করতেন, আর তিনি চাইতেন মনীষা তার চাকরী ছেড়ে দিয়ে সাধারণ গৃহবধূ হয়ে সংসারের দেখাশোনা করুক । কিন্তু মনীষা রাজি হয়নি । তাই শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স হলো ।
সুমন এখন ওড়িশাতে । মাঝে শুধু একবার দু’দিনের জন্যে সুমন বাড়ি এসেছিলো । তার নতুন অফিসের সে সর্বেসর্বা বলা যেতে পারে । প্রচুর টাকা মাইনে, উচু পদ, প্রচুর দায়িত্ব, প্রচুর কাজের চাপ, সুমন এখন একদমই সময় পায় না । কোম্পানী তাকে ভুবনেশ্বরে ফ্ল্যাট-কাজের লোক, গাড়ি-ড্রাইভার, সব দিয়েছে । মনীষাও আরো ভালো একটা চাকরীর প্রস্তাব পেয়েছে । তাই সে অনেকদিন পরে সুমনকে ফোন করলো । সুমন তার সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনলো, তার থেকে নতুন কোম্পানীর ব্যাপারে, তার মাইনের অফারের ব্যাপারে । সমস্ত শুনে সে বললো, যে পরদিন মনীষাকে তার মতামত জানাবে । পরদিন সুমন মনীষাকে বারণ করলো নতুন কোম্পানীতে যোগ দেওয়ার জন্যে । সে জানালো, টাকাটাই সব কিছু নয় । আসলে সে কোম্পানীটা সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে, কোম্পানীটা এখন খুব ভালো অবস্থায় নেই । তার মতামত শুনে মনীষা খুব একটা খুশি হলো না ।
মনীষা নতুন চাকরীতে যোগ দিয়েছে । নতুন চাকরীর ব্যাপারে বিপরীত মত দেওয়ায়, মনীষার মনে হয়েছিলো, সুমন বোধহয় তার উন্নতি হওয়াটাকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারছে না বা সুমন আর বন্ধু হিসাবে নয়, একজন কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব হিসাবে তার নতুন চাকরীতে যোগ দেওয়াটাকে দেখছে । যাই হোক, এই সমস্তই মনীষার নিজস্ব মানসিক চিন্তা । কিন্তু এই সমস্ত চিন্তার ফলস্বরূপ, মনীষার সঙ্গে সুমনের একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছে । মনীষার সঙ্গে সুমনের যোগাযোগ একদমই কমে গেছে ।
জীবনের বাঁক
মাস তিন-চারেক পরে সুমনের হোয়াটস অ্যাপে মনীষার মেসেজ আসতে লাগলো – “আমি খুব সমস্যার মধ্যে আছি । আমি তোকে কিছু বলতে চাই ।“ সুমন উত্তর দিতো, ওকে, রাতে কল করিস । কিন্তু বেশ কয়েক রাত চলে গেলো, কোন কল এলো না । সুমন ব্যপারটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিলো না । কারণ সে ভাবলো, যদি কোন গুরুতর ব্যাপার হতো, তাহলে হয়তো মনীষা নিশ্চিত কল করতো । বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলো । সুমনের হোয়াটস অ্যাপে মনীষা আবার একই মেসেজ করলো । সুমন তাকে আবার রাতে কল করতে বললো । মনীষা রাতে কল করলো, কিন্তু সে বলতে চাইলো যে ফোনে সব বলে বোঝানো যাবে না, সে মুখোমুখি দেখা করে সব বলতে চায় । কিন্তু সুমন তাকে বারবার জানালো এখুনি তার পক্ষে কলকাতায় যাওয়া সম্ভব নয় । তবু সে চেষ্টা করবে ।
এই ঘটনার দিন দশেক পরে একদিন সুমন অফিসে চলে গেছে । আজ সে একটু তাড়াতাড়িই অফিসে চলে এসেছে । কারণ আজ বিদেশ থেকে আসা বেশ কয়েকজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে । তাদেরকে প্রেজেন্টেশন দেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা রয়েছে । তার সঙ্গে সেইসব আলোচনা করে সমস্ত বিষয় পাকা করার জন্যে তারা ইতিমধ্যেই বিদেশ থেকে এসে কাছেরই একটি পাঁচতারা হোটেলে রয়েছে । সুমনদের অফিস থেকে গাড়ি গিয়ে তাদের নিয়ে আসবে । সমস্ত ব্যাপার ঠিক ঠাক হয়ে গেলে সুমনদের অফিসকে তারা একটা কাজ দেবে । যেটা প্রায় কোটি কোটি টাকার চুক্তি হবে । আর এইসব কিছু নির্ভর করছে সুমন আর তার পারদর্শিতার উপরে ।
সেইদিন মনীষা সুমনকে কল করলো । তখন প্রায় সকাল দশটা বাজে । সুমন ফোনটা রিসিভ করলো – “বল, সকালে ফোন করছিস?” ওপার থেকে উত্তর এলো – “আমি ভুবনেশ্বর এসেছি, তোকে কিছু বলতে চাই, একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবি ?” সুমন হতচকিত হয়ে গেলো – “মানে? তুই ভুবনেশ্বরে? কেন ?” উত্তর এলো – “তোর সঙ্গে আমার কথা বলা খুব দরকার, তাই । তোকে কিছু কথা আমার বলার আছে । প্লিজ একবার দেখা কর ।“ সুমন কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে শুধু বললো – “ওকে, তুই কোথায় আছিস, ঠিকানাটা আমায় পাঠা । আমি দেখছি কতো তাড়াতাড়ি আমি তোর সঙ্গে দেখা করতে পারি ।“
ফোনটা রেখে দেওয়ার পরে সুমন মাথায় দু’হাত রেখে ভাবতে লাগলো – কি এমন ঘটলো যে, মনীষা ভুবনেশ্বর চলে এসেছে তাকে কিছু বলার জন্যে । তার সব কিছু গোলমাল হয়ে যেতে লাগলো । হোয়াটস অ্যাপে ঠিকানা চলে এলো – মনীষা পাঠিয়েছে । এয়ারপোর্টের কাছে একটা হোটেলের ঠিকানা । তবে কি মনীষা ফ্লাইটে এসেছে তাকে কিছু বলার জন্যে ? অফিসের ড্রাইভার এসে জানতে চাইছে যে, সে কি ক্লায়েন্টদের আনতে তাদের হোটেলে চলে যাবে কিনা । সুমনের সম্বিৎ ফিরে এলো । ড্রাইভারকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে সে চলে গেলো কনফারেন্স রুমে ।
আরো পড়ুন - ভালোবাসার গল্প : অঙ্গীকার
অঘটনের ঘনঘটা
সারা দিনের কাজের ব্যস্ততায় সে ভুলে গিয়েছিলো মনীষার কধা । যদিও মনে ধাকলেও তার কিছু করার ছিলো না । তাদের অফিস কাজটা পেয়ে গেছে । বিদেশীরা সুমনের প্রেজেন্টেশনে এবং তার সঙ্গে আলোচনায় খুব খুশি । অফিসের সমস্ত স্টাফ এবং নতুন ক্লায়েন্টরা সবাই মিলে গেলো একটা পাঁচতারা হোটেলে ডিনারের মাধ্যনে সেলিব্রেশনের জন্যে । ডিনারের পরে ক্লায়েন্টদের গুড নাইট জানিয়ে সুমন যখন ফাঁকা হলো তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে । সুমন কল করলো মনীষার ফোনে । ফোন সুইচড অফ । সুমন ড্রাইভারকে নিয়ে হাজির হলো মনীষার দেওয়া সেই হোটেলে । হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে সুমন জানতে পারলো মনীষা রুম ছেড়ে দিয়েছে বিকাল সাড়ে পাঁচটায় । তাহলে কোথায় গেলো মনীষা ? সুমন আবার কল করলো মনীষার ফোনে - ফোন সুইচড অফ ।
সুমন কি করবে বুঝতে পারছিলো না । ড্রাইভার বাড়ি ফিরবে কিনা জানতে চাইলো । সুমন কি করবে বুঝতে না পেরে ফ্ল্যাটে ফেরার জন্যে ড্রাইভারকে বললো । ফ্ল্যাটে ফিরেই সুমন আবার একবার মনীষাকে কল করলো – কিন্তু না, ফোন সুইচড অফ । সুমন কি করবে, কাকে ফোন করবে কিছু বুঝতে পারলো না । ভালো করে ফ্রেশ হয়ে নিলো সুমন । রান্নার লোক রাতের খাবার করে, রেডি করে ফ্রিজে রেখে গেছে । কিন্তু সুমন হোটেলে ডিনার করে এসেছে । তাই ফ্রিজ থেকে একটু ঠান্ডা জল খেয়ে সে ফ্রিজ বন্ধ করে দিলো । সারা দিনের ধকলে সে প্রচন্ড ক্লান্ত, কিন্তু মনীষার জন্যে দুশ্চিন্তায় তার সারা রাত ভালো ঘুম হলো না ।
পরদিন সকালে মনীষাকে অনেক বার কল করার চেষ্টা করলো সুমন, কিন্তু প্রতি বারই সে শুনতে পেলো সুইচড্ অফ । প্রচন্ড দুশ্চিন্তা নিয়ে সুমন অফিস গেলো । অফিসে তার কাজে মন বসলো না । সারাক্ষণ চিন্তা হতে লাগলো মনীষার জন্যে । কোথায় গেলো মনীষা, কি করছে, কোথায় আছে, কি কথা বলার জন্যে সে ভুবনেশ্বরে চলে এসেছিলো, এখন সুমন কি করবে, কাকে ফোন করবে – সুমন কোন কূলকিনারা পাচ্ছিলো না । শেষ পর্যন্ত লাঞ্চের সময় সুমন আর না পেরে উঠে তার মাকে কল করলো – আর জানতে চাইলো মনীষার কি খবর, এখন কোথায় আছে ।
অন্যদিক থেকে সুমনের মা সুমনকে জানালো “মনীষা আর নেই ।“ সুমন বুঝতে না পেরে জানতে চাইলো “মানে ?” সুমনের মা কাঁদতে কাঁদতে সুমনকে বললো কাল সকালে অফিসের কাজ আছে আর ফিরতে রাত হবে বলে বেরিয়েছিলো মনীষা । অনেক রাতে ফিরেওছিলো । কিছু খাবে না, খেয়ে এসেছে, খুব ক্লান্ত – সে বিশ্রাম নিতে চায় বলে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিলো । আজ সকালে অনেক বেলা হয়ে যাওয়ার পরেও সে উঠছে না দেখে প্রথমে তোর কাকীমা ডাকাডাকি করে, কিন্তু ভিতর থেকে কোন সাড়া না পাওয়ায় দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরূ করে এবং শেষ পর্যন্ত দরজা ভেঙে সবাই দেখে সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে । কোন সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি, শুধু তার টেবিলের উপরে এক টুকরো কাগজে লেখা ছিলো – “অনেক কথা বলার ছিলো, বলা হলো না ।“

0 মন্তব্যসমূহ