ভালোবাসার গল্প : এই হৃদয়বিদারক এবং মর্মস্পর্শী "অঙ্গীকার" গল্পটি ভালোবাসার সেই শক্তির কথা বলে, যা কোনো চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। অর্পণা ও রাহুলের জীবনে আসে এক ভয়াবহ সংকট, যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে অর্পণা নেয় এক বীরোচিত সিদ্ধান্ত। এটি শুধু একটি গল্প নয়, এটি এক জীবন্ত অঙ্গীকারের ইতিহাস।
ভালোবাসার গল্প : অঙ্গীকার
কোলকাতা থেকে একটু দূরে শ্রীরামপুরে, বৃষ্টিভেজা এক সন্ধ্যায়, অপর্ণা জানলার গ্রীলে দাঁড়িয়ে দূরের গঙ্গায় ভাসা নৌকার আলোগুলো দেখছিলো । এইজন্যই, রাহুলের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটা তার খুব পছন্দ হয়েছিলো । পিছনে ড্রয়িংরুমের প্যাসেজে বসে তার স্বামী রাহুল গিটারের তারে আলতো করে সুর বুনছিলো । সাত বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছিলো, কিন্তু আজও রাহুলের দিকে তাকালে অপর্ণার বুকটা ভরে উঠতো এক অদ্ভূত ভালোবাসায়, মায়ায় – ঠিক যেন প্রথম দেখা দিনের মতোই ।
তোমার বাজনা শুনছিলাম, অদ্ভুত ভালো লাগছিলো, গঙ্গায় ভাসা নৌকাগুলো দেখতে দেখতে” । অপর্ণা ঘুরে দাঁড়ালো, তার চোখে মেশানো অপার ভালোবাসা – “তোমার বাজানো সুরে যেন কলেজের সেই পুরানো দিনগুলো ফিরে ফিরে আসে ।“
হঠাৎ রাহুলের মুখখানা কেমন যেন বিকৃত হতে লাগলো । গিটারটা টেবিলের উপর রেখে সে সামনের দিকে ঝুকে পড়ে হাতটা পেটের উপর চেপে ধরলো । রাহুলের কন্ঠস্বর কাঁপছিলো, “ব্যথাটা আবার”.....
অপর্ণা তার দিকে ছুটে গেলো । কোনরকমে রাহুলকে ধরে ধরে সে বেডরুমে নিয়ে গেলো আর বিছানায় শুইয়ে দিলো । রাহুলের কপালে ঘামের ফোটা জমছে । এই দৃশ্য গত এক বছর ধরে এখন বার বারই ফিরে আসে । প্রথমে শুধু দুর্বলতা, তারপর মাঝে মাঝেই ব্যথা, আর অবশেষে সেই ভয়ানক ডায়াগনোসিস – ক্রনিক কিডনী ডিজিজ, স্টেজ ফাইভ । ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন, কিডনী ট্রান্সপ্ল্যান্ট ছাড়া রাহুলের বাঁচার কোন দ্বিতীয় কোন রাস্তা নেই ।
ডাক্তারের কথাগুলো শুনে অপর্ণার হৃদস্পন্দন যেন থেমে গিয়েছিলো । রাহুল, যে তার জীবনের আলো, যে তার হাসি-কান্নার সাথী, যে তাকে কখনো এক পলকও একা থাকতে দেয়নি, যে তার সঙ্গে থাকবে বলে, তার সঙ্গে জীবন কাটাবে বলে তার বাড়ির সমস্ত কিছু ত্যাগ করে তাকে বিয়ে করে এই ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিলো – তাকে হারানোর ভয়ে অপর্ণার ভিতরের সমস্ত কিছু যেন অজানা আশঙ্কায় কেপে উঠেছিলো । তার চারিদিক অন্ধকারময় হয়ে উঠেছিলো । বহু কষ্টে, বহু প্রচেষ্টায় নিজেকে সামলে সে তৈরী হয়েছিলো আগামী লড়া্ইয়ের জন্য । নিজের মনের আলো থেকে জ্বালিয়েছিলো আশার প্রদীপ ।
জীবন-মৃত্যুর সংকট ও এক মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত
“ভয় পেও না, আমি তো আছি,” বলে অপর্ণা রাহুলের মাথাটা নিজের কোলের উপর তুলে নিলো, আঙুল দিয়ে রাহুলের ভেজা কপাল স্পর্শ করলো, তার আঙুলগুলো ধীরে ধীরে রাহুলের চুলে বিলি কাটছিলো । অপর্ণার অন্য হাত তুলে নিলো নিয়েছিলো তার মোবাইল ।পরের কয়েকটা মাস ছিলো নরক যন্ত্রণার মতো । ডায়ালিসিসের যন্ত্রণা রাহুলকে দিনকে দিন করে তুলছিলো দর্বল । পরিবারের সদস্যরা, বন্ধুরা – কেউ কিডনী দানের জন্য তৈরী হলো না, তারা শুনতে লাগলো প্রত্যাখানের পর প্রত্যাখান । কয়েকজন ডোনার, যাদের নার্সিংহোমের তরফ থেকে যোগাড় করে দেওয়া হলো, তাদের কয়েকজন ডোনারের কিডনী ম্যাচিং হলো না, কয়েকজনের অর্থের দাবী মেটানো তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না ।
প্রত্যেকবার একটু আশার আলো দেখার পরে যখন আশাভঙ্গ হতো, রাহুলকে দেখে অপর্ণার বুকটা ফেটে যেতো । সে বুঝতে পারতো, রাহুলের না বলা কথাগুলো, সে বাচতে চায় অপর্ণার সঙ্গে, আরো অনেক দিন, অনেক বছর । শেষে সে নিজেই একদিন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে গোপনে নিজের পরীক্ষা করালো । রিপোর্ট আসার দিন তার হাত-পা কাঁপছিলো, মনের মধ্যে চলছিলো অজস্র প্রশ্নের ঝড়, কিন্তু সে নিজেকে বারবার মনের সঙ্গে লড়াইয়ে নিজেকে শক্ত করছিলো । অবশেষে ডাক্তার এসে জানালেন, “ম্যাচ একদম পারফেক্ট, অপর্ণা । তুমি দিতে পারো ।“
তারপরে একটা মূহুর্তের জন্যও দ্বিধা না করে অপর্ণা দ্বিধাহীন, দৃঢ়কন্ঠে ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলো, “তাহলে কবে অপারেশন করবেন ?” ডাক্তার অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জানিয়ে ছিলেন সব থেকে কাছাকাছির একটা তারিখ ।
অপারেশনের ঠিক আগের রাত । রাহুল ডাক্তারের সঙ্গে তার পরামর্শের কথা, ডোনারের কথা কিছুই জানতো না, অপর্ণা জানতে দিতে চায়নি । সে চায়নি রাহুলের কোনরকম বাড়তি মানসিক চাপ বাড়াতে । নার্সিংহোমের বিছানায় শুয়ে রাহুল অপর্ণার হাত ধরে বললো, “অপর্ণা, যদি অপারেশনের সময় আমার কিছু হয়ে যায়, তুমি যেন .....” অপর্ণা রাহুলের ঠোটে আঙুল রেখে তার কথা থামিয়ে বলে, “এইসব কথা বন্ধ করো । আমি নিশ্চিত, তুমি ফিরে আসবেই সুস্থ হয়ে । আমার জন্য তুমি ফিরে আসবে । তোমার কিচ্ছু হবে না, হতে পারে না ।“ কথাগুলো বলার সময়ে অপর্ণার চোখে ছিলো অটুট বিশ্বাস ।
পরদিন, অপারেশন থিয়েটারের রুম । রাহুলকে অ্যানাস্থেশিয়া দেওয়া হয়ে গেছে । সে যেন একটা ঘোরলাগা অবস্থার মধ্যে ছিলো । সেইসময় স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হলো যে কিডনী দেবে তাকে । রাহুল সব দেখতে পাচ্ছিলো । ধীরে ধীরে তাকে শোয়ানো হচ্ছিলো তার পাশের অপারেশন টেবিলে । একি, এ যে অপর্ণা ! রাহুলের চোখে ফুটে উঠলো বিস্ময়, আতঙ্ক । সে চিৎকার করতে চেষ্টা করছিলো.... “তুমি কেন অপর্ণা ? না, বন্ধ করো এই অপারেশন । ওকে বাঁচাও, ওর কিডনী নিও না ।“ কিন্তু অ্যানাস্থেশিয়ার প্রভাবে তার কন্ঠ দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোল না, সে শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো অপর্ণার দিকে আর তার চোখের কোল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো চোখের জলের ধারা । ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি ঘোলা হতে লাগলো ।
সম্পূর্ণ অচেতন হওয়ার আগে অপর্ণা একবার রাহুলের দিকে তাকালো । অ্যানাস্থেশিয়ার ঘোরে যেন শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে । সে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে একবার স্পর্শ করলো রাহুলের হাতটা । মনে মনে সে নিজেকে বলছিলো, “তুমি জানো না রাহুল, তোমার ব্যথার সময় শ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় আটকে যায়, হৃৎপিন্ডটা যেন গলার কাছে উঠে আসে । তোমার জন্য এই দান কোন ত্যাগ নয়, এটা আমার ভালোবাসার অঙ্গীকার । আমার সুখ, চাওয়া-পাওয়া-ভালোবাসা সব কিছু যে তুমি । তুমি সুস্থ থাকলে তবেই আমি বাচবো, ভালো থাকবো ।“ নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অপর্ণার চোখে জল চলে আসে, সেই জলে ভেসে ছিলো এক অপার দৃঢ়তা, এক চূড়ান্ত উৎসর্গের শান্তি । ধীরে ধীরে তার চোখের পাতার সামনেও নেমে আসে ঘন কালো অন্ধকারের পর্দা ।
ভালোবাসার অম্লান বিজয়
ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় অপেক্ষায় । দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর একসময় ডাক্তার এসে বাইরে দাঁড়ানো আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে খবর দেন – “অপারেশন সম্পূর্ণ এবং একশোভাগ সফল ।“ অপর্ণার একটি কিডনী এখন রাহুলের শরীরে সুস্থভাবে কাজ করছে ।
জ্ঞান ফেরার পরেই রাহুল প্রথমেই যে জিনিসটা দেখলো, তা হলো ঠিক তার পাশের বেডেই শুয়ে থাকা অপর্ণার দুর্বল কিন্তু উজ্জ্বল হাসিমাখা মুখ । তার পেটের কাছে একটু ব্যান্ডেজ । রাহুলের চোখ জলে ভিজে উঠলো । কথা বলার শক্তি তাদের কারোরই ছিলো না, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতেই তারা একে অপরকে জানাতে লাগলো তাদের মনের কথা – সেখানে ছিলো একে অপরের প্রতি ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা ।
অপর্ণা বেডে শুয়েই তার হাতটা একটু বাড়িয়ে দিলো পাশের বেডের রাহুলের দিকে । রাহুল ধীরে ধীরে তার আঙুলগুলো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো । দু’জনের চোখেই ছিলো জলের ধারা । কোথাও কোন শব্দ নেই, কথা নেই – তবু দু’জনের হৃদয়ে বাজছিলো এক অসামান্য সুর – ভালোবাসার এক গভীর, নি:শব্দ সঙ্গীতের সুর । যে সুরে ছিলো আত্মদানের মহিমা, একে অপরের সঙ্গে, একে অপরের জন্য - বেঁচে থাকার আকুতি আর অঙ্গীকার ।
গল্পটি পড়ে কেমন লাগলো জানাবেন । আসলে ভালোবাসা হলো এমন এক অনন্য অনুভূতি যা একে অপরের জন্য বাঁচতে শেখায়, শেখায় ভালোবাসার জনের জন্য আহুতি, বলিদানের জন্য তৈরী হতে । যদি আপনাদেরও এরকম কোন মহান ভালোবাসার কাহিনী জানা থাকে তাহলে অবশ্যই জানাবেন আমাদের কমেন্ট বক্সে । গল্পের চরিত্রগুলো কাল্পনিক, বাস্তবের সঙ্গে এদের কোন মিল খুঁজতে যাবেন না । গল্প পড়ে ভালো লাগলে অন্যদের শেয়ার করে আমাদের উদ্বুদ্ধ হতে সাহায্য করবেন ।

0 মন্তব্যসমূহ