Recents in Beach

সুন্দরবনের রহস্যময় ভূতের গল্প - আয়েষার দীর্ঘশ্বাস

সুন্দরবনের ভূতের গল্প : সুন্দরবন, শুধু বাঘ বা সাপের জন্যই নয় । সুন্দরবন বিখ্যাত বনের মধ্যে আলো-আঁধারিতে খেলা করা অনেক রহস্যের গল্প, অনেক ভূতের গল্প, অনেক কাহিনীর জন্য । যারা সুন্দরবন গেছেন তারা মাঝি-মাল্লাদের কাছে সেইসব গল্প শুনে থাকবেন । আজ আমরা সেইরকমই একটা রহস্যময় ভূতের গল্প নিয়ে লিখবো আমাদের বাংলা ভূতের গল্প – “আয়েষার দীর্ঘশ্বাস” ।

আয়েষার দীর্ঘশ্বাস

আয়েষার দীর্ঘশ্বাস

রহস্যময় জমিদার বাড়ি

সুন্দরবনের জঙ্গল, আর তার মধ্যে একটা ছোট্ট দ্বীপ, আর সেখানে একটা দুর্গের মতো সুন্দর বাড়ি । সুন্দরবনে যারা প্রায়ই যায়, মানে যারা মধু আনতে, মাছ ধরতে বা টুরিস্ট গাইডরা যায়, তারা সবাই জানতো এই বাড়ির কথা । কিন্তু জল টপকে সেই দ্বীপে তারা নিজেরা কেউ কখনো যেতো না, আর কাউকে কখনো যেতেও দিতো না । আর তার কারণও ছিলো । কারণ সন্ধে হলেই সেই বাড়ি থেকে একটি মেয়ের চিৎকার শোনা যেতো । যেন কেউ তাকে আটকে রেখেছে, অত্যাচার করছে । কখনো কখনো দুপুরবেলাও সেই চিৎকার শোনা যেতো ।

সেখানে সেই বাড়ি নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে । লোকমুখে সেই গল্প শোনা যায় ।

অনেক বছর আগে একজন হিন্দু জমিদার তার বাগানবাড়ি হিসাবে সেই বাড়িটি বানিয়েছিলো । সেই জমিদার মাঝে মাঝে সেখানে আসতো তার বিশ্বস্ত লোকজনদের নিয়ে । শোনা যায়, তার সেই সব লোকেরা নাকি ছিলো ডাকাত । আর সেই জমিদার  বিভিন্ন ধনী লোক আর অন্যান্য জমিদারের বাড়িতে তাদের দিয়ে লুঠ করাতো আর সেই বাড়িতে ধন-সম্পদ এনে লুকিয়ে রাখতো । আর সেই সব লোকদের জমিদার প্রচুর অর্থ, ধনসম্পদ দিতো । আর তারা তার জন্যে যেকোন রকমের কাজ করতে প্রস্তুত ছিলো । সেখানে এসে তারা দিনকয়েক থাকতো, হই-হুল্লোড় করতো, তারপরে চলে যেতো ।

তারা যখন সেখানে আসতো, তখন জায়গাটা গমগম করতো । রাতে নাচ-গানের আসর বসতো । দারুণ আর দামী দামী খাবার-দাবার, পর্যাপ্ত মদ ইত্যাদি সবই চলতো । আর তার জন্যে আশেপাশের অঞ্চল থেকে এমনকি কলকাতা থেকেও তারা সব জিনিস আনাতো । স্পেশাল রান্নার জন্যে রাঁধুনী, নাচের জন্যে নর্তকী, বাজনদার ইত্যাদি সবই তারা নিয়ে আসতো ।

আয়েষার বেদনাদায়ক ইতিহাস

একবার জমিদার খবর পেলো কাছাকাছি এক গ্রামে একজন অপরূপ সুন্দরী যুবতী আছে । খবর পেয়ে জমিদার তার বিশ্বস্ত লোকদের পাঠালো । তারা খবর পাকা করে আসলো আর এসে জমিদারকে খবর দিলো । মেয়েটির নাম ছিলো আয়েষা । সে ছিলো অপরূপ সুন্দরী । তার গায়ের রং ছিলো সোনার মতো, তার চোখদুটি যেন কেউ যত্ন করে তুলি দিয়ে এঁকেছিলো । কিন্তু সে ছিলো জাতিতে মুসলমান । জমিদার সব বিবরণ শুনে তার উপরে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন । আর লোক দিয়ে তাকে ধরে আনলেন ।

আয়েষাকে ধরে আনার পরে জমিদার তাকে দেখে মোহিত হয়ে পড়লেন । আর চাইলেন আয়েষা যেন তার নর্তকী হয়ে সেখানেই থেকে যায় । কিন্তু আয়েষা কিছুতেই রাজি নয় । সে প্রাণ দিতেও রাজি ছিলো, কিন্তু সে জমিদারের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি নয় । জমিদার তখন তাকে বন্দী করে শুরু করলো তার উপরে অত্যাচার । তার সেই চিৎকার বাইরে থেকেও শোনা যেতো । কিন্তু কিছুতেই জমিদার তাকে বশ করতে পারছিলেন না । শেষে সেই জমিদার সেই বাড়ির এক গুপ্ত কালকুঠুরীতে তাকে বন্দী করে রাখলেন, তাকে জল-খাবার অবধি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হলো । সেই কালকুঠুরী থেকে তার চিৎকার আর বাইরে আসতেো না ।

এর মধ্যে আয়েষার চার ভাই, যারা সবাই তাদের জমিদারদের লাঠিয়াল ছিলো তারা তাদের জমিদারকে সব জানালো । তাদের জমিদার তখন তাদের আরো লাঠিয়াল দিলেন, অর্থ দিলেন, নৌকা দিলেন তাদের বোনকে উদ্ধার করে আনার জন্যে আর নির্দেশ দিলেন সেই অত্যাচারী জমিদারকে খতম করার জন্যে । কিন্তু এখানেই তিনি থেমে থাকলেন না, পাশের জমিদারকে তিনি খবর দিলেন এবং সব জানালেন । তার পাশের জমিদারও লোকবল, অর্থবল দিয়ে তাদের অভিযানে সাহায্য করলেন । কারণ সেই অত্যাচারী জমিদার তার গ্রামের প্রচুর ধনী লোকের ধনসম্পদ লুঠ করেছিলো ।

বিশাল বাহিনী নিয়ে আয়েষার চার ভাই সেই বাড়ি খুঁজে বার করে সেই অত্যাচারী জমিদার আর তার লোকজনদের উপরে রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করলো । আয়েষার ভাইয়েরা রাগে আর আক্রোশে সেই জমিদার আর তার লোকদের হত্যা করলো । তারপরে সারা দুর্গের মতো বাড়িটাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ালো । কিন্তু আয়েষাকে যে কালকুঠুরীতে জমিদার বন্দী করে রেখেছিলো, সেটি তারা খুঁজে পেলো না । রাত ফুরিয়ে গেলো, সকাল থেকে প্রায় অর্ধেক দিন অবধি তারা চার ভাই আর তাদের সঙ্গী-সাথীরা খুঁজলো, প্রচুর ধনসম্পদ তারা খুঁজে পেলো, কিন্তু আয়েষাকে পাওয়া গেলো না । তাদের সঙ্গের লোকজনেরা ধনসম্পদ পেয়ে আনন্দিত হলো, কিন্তু আয়েষার চার ভাই খুশি হলো না । শেষে তারা ব্যর্থ হয়ে বিষণ্ণ মনে সঙ্গের লোকজনদের সাথে নিজেদের গ্রামে ফিরে গেলো ।

তার বেশ কয়েক বছর পর থেকেই সেই বাড়িতে হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার শোনা যেতে থাকে । বেশ কয়েকবার কিছু সাহসী মানুষ সেখানে গেছে, কিন্তু চিৎকার ছাড়া তারা আর কিছুই শুনতে পায়নি । আবার কিছু মানুষ সেখানে যাওয়ার পরে আর ফিরে আসেনি । সব মিলিয়ে সেখানকার মানুষের মধ্যে সেই বাড়ি সম্পর্কে অদ্ভূত এক ভয় তৈরী করেছে । কেউ সেই বাড়িতে যায়ও না, কাউকে যেতেও দেয় না ।

বহু বছর কেটে গেছে সেইরকম ভাবেই । বাড়িটি এখন জঙ্গলে ভর্তি, বাড়ির সারা দেওয়াল থেকে অশ্বথ্থ গাছ আর আরো নানারকম আগাছা বেরিয়ে বড় বড় হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে । বাড়ির সারা দেওয়াল শ্যাওলা আর বিভিন্ন রকম আগাছায় সবুজ রং ধারণ করেছে । দেখে বোঝারও উপায় নেই, বাড়িটির আসল রং কি ছিলো । দূর থেকে দেখলেই অদ্ভূত একরকম অনুভূতি তৈরী হয় ।

তীর্থ, শুভম ও অনুপের রোমাঞ্চকর সন্ধান

সুন্দরবনে ঘুরতে গেছে শুভম, অনুপ আর তীর্থঙ্কর (তীর্থ)। তিনজনেই কলকাতার কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে । ফাইনাল পরীক্ষার পরে ছুটিতে হঠাৎ করে তারা ঠিক করে সুন্দরবনে ঘুরতে যাবে । তিনজনেই অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে এবং পড়াশোনায় খুবই ভালো । আর তারা তিনজনেই ছোটবেলার বন্ধু । সুতরাং পরীক্ষার কঠোর পরিশ্রমের পরে যখন তারা বাড়িতে সুন্দরবনে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে, তখন তাদের অভিভাবকেরা খুব একটা আপত্তি করেনি ।

সুন্দরবনে ঘুরতে এসে নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে তীর্থঙ্কর বা তীর্থের চোখে পড়ে বাড়িটা বা দুর্গটা । মাঝিকে সেখানে তারা নিয়ে যেতে বললে বয়স্ক মাঝি কিছুতেই রাজি হয় না । বরং নৌকা ঘুরিয়ে নিয়ে সেখান থেকে দূরে চলে যায় । কিন্তু বাড়িটা দেখার পর থেকেই তিনজনেই একটা রহস্য বা রোমাঞ্চের গন্ধ পাচ্ছিলো । আর তারা তিন বন্ধুই ছিলো ডাকাবুকো চরিত্রের । তিনজনেই ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট এবং খুবই সাহসী, সঙ্গে অত্যন্ত অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় । সুতরাং তারা সহজে দমলো না । আশেপাশের লোকেদের থেকে তারা খবর নিলো দুর্গটা সম্পর্কে । লোকমুখে সব ঘটনাটা শুনে তাদের কৌতূ্হল আরো বেড়ে গেলো । ঘুরতে এসে এইরকম একটা অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ পেয়ে কিছুতেই তারা সেটা হাতছাড়া করতে রাজি নয় ।

তাই তারা অনেক খোঁজার পরে একটি বছর আঠাশের যুবক মাঝি অনেক বেশি টাকার বিনিময়ে সেখানে নিয়ে যেতে রাজি হলো । আর তার সঙ্গে তাদের শর্ত হলো, মাঝি তাদের সেই দ্বীপে ছেড়ে দিয়েই চলে আসবে, যখন তারা ফিরতে চাইবে তারা মাঝির মোবাইলে ফোন করলে তবেই সে যাবে তাদের আনতে । তারা তিনজনেই তাদের মোবাইলে মাঝির নাম্বার সেভ করে নিলো । আর ঠিক হলো পরেরদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে বেলা তিনটে নাগাদ তারা রওনা দেবে সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে । তিনটের সময় তারা বেরোলে সুন্দরবনের খাঁড়ি ধরে গেলে তারা সাড়ে চারটা-পাঁচটা নাগাদ সেই বাড়ির কাছে পৌঁছাবে এবং সেখানে তারা সারা রাত কাটাবে ।

প্ল্যানমতো তারা সেইদিন সকাল থেকে তারা তৈরী হলো সেই বাড়িতে অভিযানের জন্যে । তিনজনে মিলে আলোচনা করে সেই অভিযানে যা যা দরকার লাগতে পারে, যেমন – দড়ি, ছুরি, ছোট শক্ত লাঠি, দেশলাই, মোমবাতি, টর্চ, শুকনো খাবার, জল ইত্যাদি জিনিস কিনে যোগাড় করে ফেলতে লাগলো ।   

পরেরদিন যথাসময়ে মাঝি নৌকা নিয়ে এলে তারা তিনজনেই প্রত্যেকে পিঠে একটা ব্যাগে দরকারী জিনিসপত্র আর হাতে ছোট একটা শক্ত লাঠি নিয়ে নৌকায় উঠে পড়লো । খাঁড়িতে যেতে যেতে মাঝি অনেক রকম ভাবে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলো যেন তারা সেই বাড়িতে না যায় । কিন্তু তখন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় তারা প্রায় বুঁদ হয়েছিলো । মাঝির বেশিরভাগ কথাই তারা কানেও তুলছিলো না । আর মাঝির শত বোঝানো সত্বেও তারা তখন আর ফিরে যেতে রাজি নয়, সেই বাড়ির রহস্য তারা দেখেই ছাড়বে ।

মাঝি তাদের দ্বীপে নামিয়ে দিয়েই তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো । তারা মাঝির দিকে ফিরেও তাকালো না । দ্বীপে নেমেই তারা তিনজনে হাতের ছোট লাঠি দিয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে এগোতে লাগলো বাড়িটার দিকে । বাড়িটার কাছে এসে দেখলো বাড়িটার বড় দরজায় কোন তালা লাগানো নেই, হাট করে খোলা । শুভমের কাছে একটা শক্ত লোহার রড ছিলো, সেইটা নিয়ে সে আগে আগে পা টিপে টিপে ঢুকছিলো । আসলে তখনো সন্ধে পুরো নামেনি, শেয়াল বা অন্য কোন ছোটখাটো জন্তু-জানোয়ার থাকতে পারে ভেবে তারা সন্ধের আগেই তাড়াহুড়ো করে বাড়িটাতে ঢুকে পড়তে চাইছিলো ।

বিশাল বড় দুর্গের মতো বাড়ি । সবটা একবোরে দেখা কোনমতেই সম্ভব নয়, তবুও যতোটা তারা পারলো তিনজনে লাঠি দিয়ে মাকড়সার জাল সরিয়ে পরিষ্কার করে দেখতে লাগলো । মাটিতে ধুলোর মোটা, পুরু আস্তরণ জমে আছে । কিন্তু সেখানে কোন প্রাণী বা মানুষের পায়ের ছাপ নেই । বেশ কিছুটা দেখার পরে তারা মোটামুটি আশ্বস্ত হলো যে ভিতরে কোন প্রাণী নেই । আশ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা একটু আশ্চর্যও হলো, কারণ সুন্দরবনের জঙ্গলে এইরকম একটা বাড়ি পড়ে আছে, দরজাও খোলা, অথচ কোন ছোটখাটো প্রাণীও সেখানে ঢোকেনি । যদিও এটাকে বাঘেদের ডেরা বলা চলে না, তবে তারা যেখানে হোটেলে ছিলো সেখান অবধিও নাকি বাঘেরা চলে যায়, তাহলে আর এখানে আসতে তাদের বাধা কোথায় ? তাই তারা সাবধানতার জন্যে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো । ভুতের হাতে মরা বরং ভালো, কিন্তু বাঘের পেটে তারা যেতে রাজি নয় ।    

আরো ভূতের গল্প পড়ুন - 'গল্পের ঝুলি'তে

ছোট ব্যাটারীচালিত আলো তারা সঙ্গে এনেছিলো, গোটা-দু’য়েক সেইরকম আলো তারা জ্বালিয়ে দিলো । আর চারিপাশ দেখে সিঁড়ি দিয়ে গিয়ে উপরের একটা ঘর তাদের বেশ পছন্দ হলো । ঘরটা বেশ বড়, বিছানা পত্রও আছে । ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধও করা যায়, বেশ শক্তপোক্ত । ঘরটাতে একটা আলো জ্বেলে দিতেই তারা দেখতে পেলো, বিলাসবহুল সব আসবাবে সাজানো সেই ঘর । দেওয়ালগুলো সব দামী দামী অয়েল পেন্টিংয়ে সাজানো । জিনিসপত্র কিচ্ছু নেই, তারা বুঝতে পারলো যে সব লুঠ হয়ে গেছে, কিছুই ফেলে রেখে যায়নি আয়েষার ভাইয়ের সঙ্গে যারা এসেছিলো ।

তারা যেখানটায় ঘর পছন্দ করেছিলো, তারও উপরে সিঁড়ি দিয়ে গিয়ে আরো বেশ কিছু ঘর আছে । আর আছে একটা লম্বা টাওয়ারের মতো বা পিলারের মতো উঁচু একটা গম্বুজের মতো একটা জিনিস, যা এই বাড়ির ছাদ ভেদ করে উপরে দাঁড়িয়ে আছে । আর সেই উঁচু গম্বুজের মতো জিনিসটাই বাইরে থেকে, দূর থেকে দেখে রহস্যময় লাগছে । টাওয়ারের মতো সেই জিনিসটা কিসের জন্যে, কেন সেখানে করা হলো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না । বেশ শক্ত পাথর গেঁথে তৈরী, কোন দরজা নেই, জানলা নেই, কিছু্ই নেই । শুধু মাত্র দারুণ শক্ত, লম্বা একটা বিশাল মোটা আর থামের মতো উচু একটা গম্বুজ । তীর্থর খুব আশ্চর্য লাগছিলো, গম্বুজটা দেখে । সে বারবার গম্বুজটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছিলো ।

যাই হোক, মোটামুটি গোটা বাড়িটাই তারা তিনজনে দেখে নিয়েছে । ঘরের ভিতরে জন্তু-জানোয়ারের কোন ভয় সেরকম নেই, যদি না বাইরে থেকে মানুষের গন্ধ পেয়ে বাঘমামা এসে না ঢোকেন । কারণ নীচের সদর দরজাটার উপরে বিশেষ ভরসা করার মতো অবস্থায় সেটা নেই ।

তারা তিনজনে উপরের ঘরে বসে কিছু শুকনো খাবার খেয়ে নিলো । রাতে খিদে পেলে আবার খাবে । খাবার দাবার তারা প্রচুর এনেছে, সেদিক থেকে চিন্তার কিছু নেই । রহস্যজনক কিছু না ঘটলেও বিভিন্নরকমের খাবার, কোল্ড-ড্রিঙ্কস খেয়ে রাতটা মজাতেই কাটানো যাবে । তিনজনেই গান শোনার জন্যে ইয়ারফোন, মোবাইলে চার্জ করার জন্যে পাওয়ার ব্যাঙ্ক ইত্যাদি সবই এনেছে । সুতরাং সেইসব দিক থেকে টেনশনের কিচ্ছু নেই । কিছু না ঘটলেও, রাতটা বোর হয়ে কাটবে না ।

খাওয়া-দাওয়ার পরে তারা তিনজনে বসে গল্প করছিলো । হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেলো তারা । মনে হচ্ছে, কেউ যেন চাবুক দিয়ে কোন মেয়েকে মারছে আর মেয়েটি চিৎকার করছে । তারা তিনজনে আন্দাজ করার চেষ্টা করতে লাগলো, কোথা থেকে আওয়াজটা আসছে । কিন্তু তারা কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না, কোথা থেকে আওয়াজ আসছে । কখনো মনে হচ্ছে উপর থেকে আওয়াজটা আসছে, কিন্তু তারা উপরে গেলে মনে হচ্ছে নীচে থেকে আওয়াজটা সেখান থেকে আসছে ।

তারপরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চললো কান্নার আওয়াজ । সে আওয়াজ শুনলে যেকোন মানুষের হাড় হিম হয়ে যাবে । তিন বন্ধু মিলে অনেক চেষ্টা করলো কোথা থেকে আওয়াজ আসছে, খুঁজে বার করার । কিন্তু কোনভাবেই তারা না কাউকে দেখতে পেলো, না পেলো এমন কোন সূত্র যাতে বোঝা যায় যে আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে । তখন তীর্থঙ্কর হঠাৎ সেই গম্বুজের কাছে গিয়ে বলতে লাগলো, “দ্যাখো, তুমি যেই হও, আমরা তোমায় বিরক্ত করতে আসিনি । আমরা চাই, তোমাকে সাহায্য করতে । যদি আমাদের সাহায্য পেয়ে তুমি এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পাও, তাহলে আমাদের ভালো লাগবে ।“ তীর্থঙ্কর কথাগুলো বলার পরে হঠাৎ সব চুপচাপ, নিস্তব্ধ হয়ে গেলো । চারিদিকে সব সুনসান, কোথাও কোন আওয়াজ নেই । অনেকক্ষণ তারা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পরে তারা তিনজনে আবার নিজেদের ঘরে ফিরে গেলো । 

বেশ কয়েক ঘন্টা সময় কেটে গেলো । তারা তিনজনে জেগে থাকার জন্যে কেউ গান শুনছিলো, কেউ বা মোবাইলে সিনেমা দেখছিলো । হঠাৎ তাদের মনে হলো, অনেক মানুষ যেন এই বাড়িটাতে ঢুকে পড়েছে আর এদিকে সেদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে । তারা ঘর থেকে বেরিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না, শুধু মাঝে মাঝে যেন তাদের শরীরে হঠাৎ হঠাৎ যেন একটা হাওয়ার দমকা আছড়ে পড়ছিলো । তারা শুনতে পারছিলো, যেন প্রচুর লোক দুর্গময় ছুটে বেড়াচ্ছে, কিন্তু তারা কাউকে বা কিছুই দেখতে পাচ্ছিলো না । শুধুমাত্র যখন হাওয়ার ঝাপটা তাদের উপরে এসে পড়ছিলো, সেই হাওয়াটা তারা অনুভব করতে পারছিলো । প্রচন্ড ঠান্ডা একটা হাওয়া আর তাতে কেমন যেন একটা সোঁদা সোঁদা, আঁশটে গন্ধ । তারা কিছুই বুঝতে না পেরে আর কিছুই করতে না পেরে শুধুমাত্র পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিলো, বেশ কিছুক্ষণ এইরকম চলার পরে হঠাৎ তীর্থঙ্কর তার অন্য দু’জন বন্ধুকে একটু ধাক্কা মারতে তাদের যেন সম্বিৎ ফিরে এলো । তীর্থ মুখের ইশারায় কথা বলতে বারণ করলো তাদের, আর ইশারা করলো ঘরে ঢুকে পড়তে । কোনরকমে তারা তিনজনে ঘরে এসে ঢুকে পড়লো । বাইরে আরো বেশ কিছুক্ষণ ধরে হই-হট্টগোল চললো । তারপরে সব আবার শান্ত হয়ে গেলো । তারা তিনজনে একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছিলো । তিনজনেই বেশ বুঝতে পারছিলো, তিনজনের সম্মোহিতের মতো অবস্থা হয়ে পড়েছিলো ।

'ভালোবাসার গল্প' পড়ুন 'গল্পের ঝুলি'তে

সব কিছু শান্ত হয়ে যাওয়ার পরে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলো, এইসব ব্যাপার নিয়ে । এইসব কি ব্যাপার ঘটছে, কেন তাদের এইরকম সম্মোহিতের মতো অবস্থা হয়ে পড়েছিলো । এরপরে কি ঘটতে পারে বা কি করে তারা সকাল অবধি কাটাবে ইত্যাদি । তীর্থ তাদের বোঝাচ্ছিলো, চিন্তার কোন কারণ নেই । ভালো এবং দুষ্ট আত্মা দু’রকমই এখানে আছে । কিন্তু ভালো আত্মার শক্তি বেশি । আর সে তাদের রক্ষা করতে চাইছে । তাদের কোন চিন্তা নেই । তখন তার দুই বন্ধু তীর্থকে চেপে ধরলো যে সে এইরকম কেন বলছে । কি এমন সে বুঝতে পেরেছে বা দেখতে পেয়েছে যা তারা দেখতে বা বুঝতে পায়নি । তখন তীর্থ বললো, যখন আমরা বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম, আমিও নড়তে পারছিলাম না । কিন্তু কেউ যেন, মানে যেন একটা মেয়ে আমাকে নড়িয়ে দিয়ে কানে কানে বললো, “ভিতরে যাও, ওরা সবাইকে মারতে এসেছে । আর নীচের ঘরে একদম যেও না । আমি আবার পরে আসবো ।“

রাতের আত্মা এবং গুপ্ত কুঠুরীর রহস্য

বেশ কয়েক ঘন্টা কেটে গেছে, মাঝরাত টপকে গেছে । আর কিছুই ঘটেনি । শুধু বাইরে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেছে । আবহাওয়াটা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা মতো হয়ে গেছে । তিনজনেরই হালকা ঘুম আসছে । হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো, আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সমস্ত আলো বন্ধ হয়ে গেলো । শুভম উঠে আলোটায় কি হয়েছে দেখতে যাচ্ছিলো, তীর্থ বারণ করলো আর বললো, “যে যেখানে আছিস, নড়িস না । সে আসতে চাইছে আর আমাদের কিছু বলতে চাইছে । ভয় নেই, ও আমাদের ক্ষতি করবে না ।“          

গন্ধটা বেশ তীব্র হতে লাগলো । বদ্ধ ঘরের মধ্যে অনেকগুলো দারূন সুগন্ধি ধুপ জ্বাললে যেরকম হয়, সেইরকম সুন্দর, তীব্র গন্ধে ঘরটা ভরে গেলো । অন্ধকার ঘরের মধ্যে তাদের সামনে একটা জায়গায় যেন একটা ধোঁয়ার কুন্ডলী আস্তে আস্তে জমাট বাঁধতে লাগলো । ধোঁয়াটা ধীরে ধীরে জমাট বেঁধে যেন একটা মানুষের মতো অবয়ব নিলো । আর অন্ধকারেও তারা তিন বন্ধু সেই জমাট বাঁধা ধোঁয়ার মতো মানুষের অবয়বটা দেখতে পাচ্ছিলো । ধীরে ধীরে তারা শুনতে পারছিলো যেন একজন মেয়ে ক্ষীণ স্বরে কিছু বলতে চাইছিলো । শুভম আর অনুপ প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলো না । তীর্থ তাকে প্রশ্ন করলো “তুমি কে ?” উত্তর এলো “আমি আয়েষা ।“ তীর্থ বললো “তাহলে আমরা লোকেদের কাছ থেকে যে কাহিনী শুনেছি, সেটা সত্যি । বলো আয়েষা, আমরা তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি, আমরা তোমাকে মুক্ত করতে চাই ।“ আয়েষা বলে উঠলো “তোমরা আমায় সাহায্য করবে ?” তীর্থ বললো, “অবশ্যই করবো । শুধু তোমায় আমাদের একটু সাহায্য করতে হবে । কি করলে তোমার মুক্তি ঘটবে বলো আমাদের ?”

এখন অনুপ আর শুভমও আয়েষার গলা শুনতে পাচ্ছিলো । আয়েষা বলে উঠলো, “গম্বুজের মধ্যে লুকানো দরজার পেছনে রয়েছে গুপ্ত কুঠুরী । সেই কুঠুরীতে আমার কঙ্কাল পড়ে রয়েছে, সেটাকে বাইরে নিয়ে এলেই আমি এই দুর্গ থেকে বেরোতে পারবো, আর সেই কঙ্কাল নিয়ম মেনে কবর দিলেই আমি মুক্তি পেয়ে যাবো ।“ তীর্থ বললো, “দ্যাখো আমার সন্দেহ হয়েছিলো যে ওই গম্বুজের পিছনেই কোন রহস্য লুকিয়ে আছে । কিন্তু ওই গম্বুজের কাছে গিয়ে আমি এমন কিছু দেখতে পাইনি, যাতে আমরা তার লুকানো দরজার পিছনের ঘরটা খুঁজে পাবো । তোমায় এই ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে হবে ।“ তখন আয়েষা বলে উঠলো, “এই ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা গেলে তুমি সেই গম্বুজের দেওয়ালে ধাক্কা খাবে । সেখান থেকে ঠিক দু’পা ডানদিকে সরে গেলেই দেখতে পাবে তোমার ডানহাতের কাছে একটা অন্যরকম পাথর । যার সঙ্গে গম্বুজের দেওয়ালের বাকি পাথরগুলোর কোন মিল নেই । সেই পাথরে চাপ দিলেই খুলে যাবে গুপ্ত কুঠুরীর দরজা ।“ এই কথাগুলো বলার পরেই যেন জমাট বেঁধে থাকা ধোঁয়াগুলো যেন বৃষ্টির মতো ঝরে পড়লো, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রবল দমকা হাওয়া যেন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো ।

প্রায় ভোর হয়ে আসছে, তিন বন্ধু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো গম্বুজের সামনে । তারপরে আয়েষার নির্দেশমতো দু’পা ডানদিকে সরতেই দেখতে পেলো একটা যেন অন্যরকম পাধর দিয়ে একটা জায়গা গাঁথা রয়েছে । মানে সব পাথরই চারকোণা, কিন্তু একটা পাথর যেন ঠিক চারকোণা নয়, বরং পাঁচকোণা বা ছয়কোণা বলা যেতে পারে । তীর্থ সেই পাথরটার উপরে চাপ দিতেই দেওয়ালের কিছু অংশ ফাঁক হয়ে একটা নীচে যাওয়ার সিঁড়ি দেখা দিলো । দেওয়ালটা সরতেই যেন অনেকদিন ধরে চাপা বহু দীর্ঘশ্বাস একসঙ্গে পড়ার মতো একটা আওয়াজ হলো । সঙ্গে বেরিয়ে এলো একটা বোঁটকা গন্ধ । তিনজনেই মুখে মাস্ক পরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো । ঘোরানো সিঁড়ি ধরে বেশ অনেক গভীরে নেমে আসার পরে একটা ঘর মতো জায়গায় এসে তারা পৌঁছালো আর দেখতে পেলো নামাজ পড়ার ভঙ্গিতে রয়েছে একটা কঙ্কাল । ঘরটার মধ্যে যেন বহু কান্না, বহু দীর্ঘশ্বাস বদ্ধ হয়ে রয়ে গিয়েছে । ওই অবস্থায় সেই কঙ্কালটিকে দেখতে পেয়ে তাদের তিন বন্ধুরই মধ্যে যেন একটা দলা পাকানো কান্না ঠেলে উঠে আসছিলো । কেউ কিছু না বলে দিলেও তারা সব বুঝতে পারলো যে আয়েষা এখানে খিদে-তৃষ্ণায় মারা গেছে, কিন্তু মারা যাওয়ার আগে অবধি সে তার ইষ্ট ঈশ্বরকে স্মরণ করে গেছে । আর তাই মৃত্যুর পরে সে পেয়েছে এতো শক্তি, আর সেই শক্তির সাহায্যে সে তাদের তিন বন্ধুকে রক্ষা করতে পেরেছে দুষ্ট আত্মাদের থেকে, আর তাদের সামনে এসে আবেদন করেছে তাকে মুক্তি দেবার জন্যে ।

আয়েষার চিরস্থায়ী মুক্তি

সকাল বেলায় তীর্থ তাদের মাঝিকে ছোট করে ঘটনাটা জানিয়ে বেশ কিছু লোকজন নিয়ে সেখানে আসার জন্যে ফোন করলো । মাঝি লোকজন, সঙ্গে পুলিশ নিয়ে এসে হাজির হলো । তারা এসে পৌঁছানোর পরে সবাই মিলে কঙ্কালটিকে নিয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসার পরে একটা দমকা হাওয়া যেন ঝড়ের মতো বাড়িটার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে মিশে গেলো প্রকৃতির বুকে । আশেপাশের বড় বড় গাছ গুলো যেন তাদের নিকট কোন আত্মীয়ের মুক্তির প্রবল আনন্দে মাথা নাড়তে লাগলো । আকাশে-বাতাসে যেন এক মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো । যেন অপরিচিত কোন ফুলের সুবাস ।

অনুপ, শুভম আর তীর্থ তিনজনে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশের সাহায্য নিয়ে আয়েষার ধার্মিক রীতি-নীতি মেনে তার কবরের সবরকমের ব্যবস্থা করলো । আয়েষার কবরের সমস্ত ব্যবস্থা কিছু হয়ে যাওয়ার পরে তাকে তার ধর্মের রীতি-নীতি মেনে কবর দেওয়া শেষ হলে, সেখানে যারা যারা ছিলো তারা সকলেই অনুভব করলো যেন দীর্ঘদিন ধরে জমানো গভীর এক দীর্ঘশ্বাস কবর থেকে উপরে আকাশের দিকে উঠে গেলো আর অদৃশ্য কেউ যেন আশেপাশের গাছ-গাছালি আর হাওয়া মিলেমিশে একাকার হয়ে যেন ফিসফিস করে বারবার বলে উঠলো “ধন্যবাদ, ধন্যবাদ তোমাদের সবাইকে ।”

 

আপনার কি সুন্দরবন নিয়ে কোন রহস্যময় অভিজ্ঞতা আছে? নীচে কমেন্ট করে জানান! গল্পটি ভালো লাগলে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, চেনা-পরিচিতদের মধ্যে অথবা আপনার সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার অনুরোধ রইলো । “গল্পের ঝুলি” পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ । 

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ